• পশ্চিমবঙ্গের সফল রূপকার ডা. বিধানচন্দ্র রায়
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ০১ জুলাই ২০২৫
  • আজ ১ জুলাই, মঙ্গলবার, ২০২৫। ডা. বিধান চন্দ্র রায়ের ১৪৩তম জন্মবার্ষিকী। প্রতি বছর এই দিনটি সারা দেশে ‘ডক্টর’স ডে’ হিসেবে পালিত হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ডা. রায়কে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। বিধান শিশু উদ্যানেও আয়োজন করা হয়েছে ডা. রায়ের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন অনুষ্ঠান। উপস্থিত থাকবেন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশিষ্টজনেরা। অবশ্যই সঙ্গে থাকবে উদ্যানের সভ্য-সভ্যা কয়েক হাজার শিশু কিশোর।

    ইচ্ছে ছিল এই অবকাশে ডা. বিধান চন্দ্র রায় সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু লেখার। রসদ সংগ্রহের বাসনায় ডা. রায়কে নিয়ে তাঁরই অত্যন্ত স্নেহভাজন এবং একনিষ্ঠ অনুগামী অতুল্য ঘোষের একটি লেখা পড়তে পড়তে আমার নিজের লেখার ইচ্ছে আমার কাছেই দুঃসাহস বলে মনে হল। ফলে ডা. রায়কে নিয়ে অতুল্য ঘোষের স্মৃতিচারণের কিছু কিছু অংশ দিয়েই এই লেখা শুরু করলাম—

    ‘ডা. রায়কে নিয়ে কিছু লেখাও একটু বিপজ্জনক। কোনও অসতর্ক মুহূর্তে কোনও একটি বিষয় হয়ত বাদ পড়ে যেতে পারে। আধুনিক ভারতবর্ষে ঠিক এরকম লোক বেশী জন্মাননি। বেশী কেন, জন্মাননি বললেও অত্যুক্তি করা হয় না। গোড়া থেকে শেষ অবধি ডা. রায়ের জীবন খুবই উল্লেখযোগ্য। ছেলেবেলায় যেমন ছিল শরীর খারাপ, সেরকমই ছিল ভূতের ভয়। অথচ পরিণত বয়সে সেই লোক বিশেষ কখনও অসুস্থ হননি। এটা নিজের চেষ্টায়। মেধাবী ছাত্র ছিলেন না এবং ডাক্তারী পরীক্ষায় একবার ফেলও করেন (যদিও তাঁর নিজের দোষে নয়)। সেই লোক টপ্ করে এম.ডি পাশ করলেন। বিলেতে গিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই দুটি পরীক্ষায় কৃতিত্ব সহকারে উত্তীর্ণ হলেন এবং একটিতে আবার প্রথম হলেন। শুনলে বেশ গল্প বলে মনে হয়। কিন্তু নিজের চেষ্টায় এটা সম্ভব করেছিলেন। কলকাতায় এসে ডাক্তারি আরম্ভ করলেন। সামান্য চাকরি। কিন্তু দেখতে দেখতে কয়েক বছরের মধ্যেই চিকিৎসা শাস্ত্রের সর্ব্বোচ্চ যে পরিষদ (Indian Medical Council) তার প্রথম বেসরকারি সভাপতি হলেন। অথচ বাল্যকালে যখন শিক্ষার্থী ছিলেন, তখন কোনও বিষয়েই প্রতিভার তেমন স্ফুরণ দেখা যায়নি।

    কলিকাতা কর্পোরেশনে গেলেন। তখন চিকিৎসক হিসাবে খুব পশার। সময়ের একান্ত অভাব। তবু কোথা থেকে সময় বার করে নিলেন এবং অক্লান্ত খেটে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন। এবং মেয়র। বিশ্ববিদ্যালয়েও তাই। Finance কমিটিতে রগড়াতে রগড়াতে, তারপরেই ভাইস চ্যান্সেলার। যেখানেই যাচ্ছেন, সর্ব্বোচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন— কেউ বসিয়ে দিচ্ছে না। সবটাই নিজের চেষ্টায়। অদ্ভুত মনে হয়। রাজনীতিতে প্রবেশ করলেন। দেশবন্ধুর স্নেহভাজন হওয়া সত্ত্বেও প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে দাঁড়ালেন নির্দল প্রার্থীরূপে এবং তখনকার ভারতবর্ষের সবচেয়ে শক্তিধর রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে জয়ী হলেন। সেসময়ে দেশবন্ধুর কাছ থেকে দলীয় ছাপ নেবার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল। উনি কিন্তু নেননি। নিজের কর্মপ্রবাহ বাংলাদেশের মধ্যেই আবদ্ধ রেখেছিলেন এবং কংগ্রেসে ঢোকার পরই দেখা গেল কয়েক বছরের মধ্যেই প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভাপতি। ওয়ার্কিং কমিটির মেম্বার এবং গান্ধীজি ও পণ্ডিত মতিলালের একান্ত স্নেহভাজন ও আস্থাভাজন। রাজনীতির মধ্যে ঢুকলেন, কিন্তু অন্যান্য দিকে যেসব কাজ আরম্ভ করেছিলেন, তার কোনওটার সঙ্গেই সম্পর্ক ত্যাগ করেননি। যখন হরিজন সেবক সঙ্ঘ সংগঠিত হল বাংলাদেশে, প্রথম সভাপতি বিধানচন্দ্র।

    স্বাধীনতার পর ভারতবর্ষের বৃহত্তম প্রদেশের রাজ্যপালের পদ গ্রহণ করার জন্য আহূত হলেন। তখন রাজ্যপালের পদ ছিল মর্যাদা ও দায়িত্বে মণ্ডিত। কিন্তু বিধানচন্দ্র সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলেন। হতে চেয়েছিলেন পশ্চিমবাংলার Development Board-এর চেয়ারম্যান। গান্ধীজির অনুরোধে, যা ছিল তাঁর অন্তিম অনুরোধ, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হলেন। প্রদেশ কংগ্রেসে যেসব নেতারা তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছিলেন, তাঁদের মধ্যে দলাদলির আভাস পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বিধানচন্দ্র বলে দিলেন যে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হবেন না। সারা জীবন এটা দেখা গেছে যে কোনও কিছু হওয়া বা না হওয়ার মধ্যে তিনি বিশেষ পার্থক্য করতেন না। অথচ নির্লিপ্তও ছিলেন না। এ একটা অদ্ভুত চরিত্র।’
    ডা. বিধান চন্দ্র রায় সম্পর্কে অতুল্য ঘোষ যা লিখেছিলেন তার বেশ কিছুটা অংশ এখানে তুলে ধরলাম। তবে স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রশ্ন আসে— দলের মধ্যে তাঁর মুখ্যমন্ত্রীত্ব নিয়ে মতপার্থক্য আছে জেনে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হবেন না বলে জানিয়েছিলেন। তারপর কি এমন ঘটলো যে ডা. রায় আবার মুখ্যমন্ত্রীত্বের আসন গ্রহণ করতে রাজি হলেন? বলা বাহুল্য, এক্ষেত্রে অতুল্য ঘোষের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

    তখন প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন সুরেন্দ্র মোহন ঘোষ। সকলের কাছে তিনি মধুবাবু বলেই পরিচিত। তিনি যে মুখ্যমন্ত্রী হতে আগ্রহী, একথা সরাসরি না বললেও প্রদেশ কংগ্রেসের বেশ কিছু প্রভাবশালী নেতাদের বোঝাতে সমর্থ হয়েছিলেন, প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষের পর তিনিই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসার জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি। এরকম এক টালমাটাল অবস্থায় আসরে অবতীর্ণ হলেন হুগলি জেলা কংগ্রেস সভাপতি অতুল্য ঘোষ। তখনও তিনি রাজ্যস্তরে দলীয় কোনও পদাধিকারী নন। তবে তাঁর অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা এবং বাগ্মিতা রাজ্যস্তরের বড় বড় নেতাদের অজানা ছিল না। প্রফুল্ল চন্দ্র সেন, ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, যাদবেন্দ্র নাথ পাঁজা, অজয় মুখোপাধ্যায়, কালীপদ মুখোপাধ্যায়দের মতো তাবড় তাবড় নেতাদের অতুল্য ঘোষ বোঝাতে সমর্থ হয়েছিলেন— এমন একজন ব্যক্তি মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসুন, যিনি রাজ্যের স্বার্থে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে দাবি আদায় করতে পারবেন। এরকম মানুষ একজনই আছেন। তিনি ডা. বিধান চন্দ্র রায়। তাছাড়া ডা. রায়ের প্রতি পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর শ্রদ্ধা সর্বজনবিদিত। সুতরাং ডা. রায় মুখ্যমন্ত্রী হলে রাজ্যের মঙ্গলই হবে। ১ জুলাই ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ডা. বিধান চন্দ্র রায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। জ্বলন্ত উদ্বাস্তু সমস্যা সামলেছিলেন অসাধারণ প্রশাসনিক দক্ষতায়। সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশের একটি অঙ্গরাজ্যকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করে তোলার ক্ষেত্রে ডা. রায়ের ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তবে তাঁর দীর্ঘ ২৪ বছরের মুখ্যমন্ত্রীত্বের সময়কাল যে সম্পূর্ণ বিতর্কমুক্ত ছিল, তা বলা যাবে না। তবুও তিনি যে সবদিক থেকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন প্রশাসক ছিলেন একথা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই। ডা. বিধান চন্দ্র রায় তাঁর দীর্ঘ চলার পথে সবসময়েই পাশে পেয়েছিলেন অতুল্য ঘোষকে। ডা. রায় জানতেন অতুল্য ঘোষ উচ্চাকাঙ্খী ছিলেন না। সংকীর্ণ দলাদলিরও ঊর্ধ্বে ছিলেন। ডা. রায়ের মুখ্যমন্ত্রীত্বের প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত কখনও প্রশাসনের ওপর দলীয় আধিপত্য কায়েম করতে দেননি অতুল্য ঘোষ।
    আবার ফিরে আসি ডা. রায়কে নিয়ে অতুল্য ঘোষের লেখার মধ্যে।

    ‘ভারতরত্ন পাচ্ছেন শুনে যেমন কোনও উৎসাহ দেখা যায়নি, তেমনই বুলগানিন, ক্রুশ্চেভ-এর সঙ্গে নৈশভোজ খেতে যেতেও সেইরকমই মনোভাব।… (আশির দশকে) পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী জ্যোতি বসু এক জনসভায় প্রকাশ্যভাবেই বললেন, ‘যে কাজই করতে যাই, দেখি ডা. রায় শুরু করে গেছেন।’ জ্যোতিবাবু বরাবরই বিরোধী দলের নেতা ছিলেন। তাঁর মুখের এই স্বীকারোক্তির পর এ সম্বন্ধে আর বিশেষ কিছু বলার প্রয়োজন নেই।’

    ডা. বিধান চন্দ্র রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে এতক্ষণ যা লিখলাম তার সবটাই প্রায় অতুল্য ঘোষের স্মৃতিচারণ থেকে নেওয়া।
    এবার ডা. রায় তাঁর নিজের সম্পর্কে যা বলেছেন তার কিছু অংশ উল্লেখ করবো।

    ‘জীবনে আমার কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। আমার জীবনের একমাত্র আদর— যখন যে কাজ হাতে আসবে, তখন তা সর্বশক্তি দিয়েই করবো।…বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এবারে আমি কী করতে চাই।’ স্যর জন উডবার্ন ছিলেন তখনকার লেফটেন্যান্ট গভর্নর। ব্রাহ্মসমাজের সর্বজনপরিচিত নেতা শ্রদ্ধেয় প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে তাঁর ছিল বন্ধুত্ব। স্যর জন তাঁকে বলেছিলেন যে, শ্রদ্ধেয় মজুমদারের সুপারিশ থাকলে, ব্রাহ্মসমাজের তিনটি বুদ্ধিদীপ্ত যুবককে তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি দেবেন। সেই তিনটি পদের একটি আমাকে দিতে চাওয়া হলো। সে কথা শুনে বাবা বললেন যে, তিনি ত্রিশ বছর সরকারী চাকরি করেছেন, তিনি চান না যে, ছেলেরা, প্রকৃতপক্ষে তাঁর অধস্তন তিন পুরুষের কেউ, সরকারের অধীনে চাকরি করুক। তারপর তিনি আমার ঝোঁকটা কোন্ দিকে তা জানতে চাইলেন। তার জবাবে বাবাকে আমি বললাম, বিশেষ কোনো একটা দিকে আমার কোনো ঝোঁক নেই।… আমি শিবপুর এঞ্জিনীয়ারিং কলেজ আর কলকাতা মেডিকেল কলেজ দু’জায়গাতেই ভরতি হবার জন্য দরখাস্ত পাঠালাম। তারপর যা ঘটলো, সেটা নেহাতই একটা আকস্মিক ব্যাপার। একই দিনে দু’জায়গা থেকে দরখাস্তের জবাব এলো।

    সকাল দশটায় মেডিকেল কলেজের চিঠি পেলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে মনি-অর্ডার ক’রে ভরতি হবার ফী পাঠিয়ে দিলাম সেই কলেজের ঠিকানায়। ভরতিও হয়ে গেলাম সেখানে। ওদিকে সেইদিন বিকেলেই এলো শিবপুর এঞ্জিনীয়ারিং কলেজের চিঠি। দরিদ্র সন্তান হিসাবে আমি যদি শিবপুরে ভরতি হতাম, তা’হলে আর্থিক দিক থেকে সুবিধে হ’তো। কেননা, সেখানে স্কলারশিপটা পেতাম, পড়াশোনার খরচটা তাতেই চ’লে যেতো। কিন্তু আমার মধ্যে পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না, জীবনের পথে যা এসে গেল তা-ই গ্রহণ করলাম। মেডিকেল কলেজে ইতিমধ্যেই ভরতি হবার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি, কাজেই সেইখানেই পড়বো ব’লে মনস্থির ক’রে ফেললাম।’
    ডা. বিধান চন্দ্র রায়কে আমরা কীভাবে মনে রাখব তা বলা মুশকিল। তাঁকে বাংলার রূপকার বলে মনে রাখতে পারি বা সর্বকালের অন্যতম সেরা একজন চিকিৎসক হিসেবেও মনে রাখতে পারি। তিনি যে জীবনদর্শনকে অবলম্বন করে নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর সমস্ত কর্তব্য সম্পাদন করে গেছেন, সেজন্য তাঁকে আমরা সত্যিকারের একজন কর্মবীর হিসেবেও মনে রাখতে পারি। এক জন্মদিনের দিনই চলে গিয়েছিলেন ডা. বিধান চন্দ্র রায়। এ এক বিরল সমাপতন। সবদিক থেকেই তিনি ছিলেন অনন্য। জন্মদিনে তাঁকে জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)