• দিল্লিতে নির্বাচন কমিশনের সদর দপ্তরে তৃণমূলের পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ০২ জুলাই ২০২৫
  • ভোটার তালিকা সংশোধন সংক্রান্ত বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রতিবাদে মঙ্গলবার দিল্লিতে নির্বাচন কমিশনের সদর দপ্তরে গেলেন তৃণমূলের পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল। লোকসভায় তৃণমূলের মুখ্য সচেতক কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন রাজ্যের তিন মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, অরূপ বিশ্বাস ও ফিরহাদ হাকিম। এছাড়া ছিলেন রাজ্যসভার সাংসদ প্রকাশ চিক বরাইকও। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের সদর দপ্তরে তাঁরা সাক্ষাতের পর একটি সাংবাদিক বৈঠক করেন।

    বিহারের ভোটকে কেন্দ্র করে কমিশনের জারি করা বিজ্ঞপ্তি ঘিরে অনেক জল ঘোলা হয়েছে, অনেক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ভোটার তালিকা সংশোধন নিয়ে তৃণমূলের সঙ্গে সঙ্গে আরজেডি ও  অন্যান্য বিরোধী দলগুলির অভিযোগের শেষ নেই। এমতাবস্থায়, দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির তোপের মুখে কিছুটা হলেও অন্য পথে চলে বিতর্ক এড়াতে চাইছে কমিশন।

    বঙ্গে আগামী বছর ভোট হলেও তার আগে এই বছরের শেষে বিহারে ভোট, ঠিক তার আগে তৃণমূলের সঙ্গে সঙ্গে সুর চড়িয়েছে আরজেডি-ও। তাই বঙ্গের প্রধান রাজনৈতিক দল তৃণমূলের বিরোধিতাকে শান্ত করতে ভোটার তালিকা সংশোধন নিয়ে দেওয়া হচ্ছে ছাড়। মঙ্গলবার, দিল্লির সদর দপ্তরে নির্বাচন কমিশনের আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন তৃণমূলের পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল। বৈঠক শেষে বেরিয়ে সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ওনারা নিজেদের আগের সিদ্ধান্তের থেকে কিছুটা সরে আসছেন, আমাদের তোলা পয়েন্টগুলি নিয়ে বিশেষভাবে বিবেচনা করবেন বলেছেন।”

    তৃণমূলের দাবি, ২০২৪ সালে যে সব ভোটার আছে, কোনও শর্ত ছাড়াই সে সব ভোটারের নাম তালিকায় থাকবে। তিনি বলেছেন, “ওরা এটা নিয়ে নোট নিয়েছেন। বলেছেন, আমরা চিন্তা-ভাবনা করব। জন্মের শংসাপত্র নিয়ে সমস্যা হয়েছিল (১৯৮৭ এবং ২০০৩), ওরা বলেছে, আমরা এতে রিলাই করব না। যাঁরা ভোটার আছে, তাঁরা ভোটার থাকবেই।”

    বাবা-মায়ের জন্মতারিখ ও জন্মস্থানের প্রমাণ দেওয়ার ইস্যুতে গর্জে উঠেছিলেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সাফ দাবি, বিহার তো বাহানা, নির্বাচন কমিশনের আসল টার্গেট বাংলাই। আসলে তৃণমূল সমর্থকদের বাদ দিয়ে, ‘বহিরাগত’দের নাম ভোটার তালিকায় ঢোকানোর ষড়যন্ত্র করছে মোদী সরকার। মমতা ব্যানার্জীর পর সরব হন বিহারের বিরোধী দলনেতা আরজেডির তেজস্বী যাদবও। এরপরই ভোটার তালিকার ‘স্পেশাল ইন্টেনসিভ রিভিশন’ (এসআইআর) নিয়ে ঢোঁক গিলতে বাধ্য হল নির্বাচন কমিশন। সোমবার রীতিমতো বিবৃতি দিয়ে কমিশন জানিয়ে দিল, বিহারে ২০০৩ সালের ভোটার তালিকায় যাঁদের নাম রয়েছে, তাঁদের কোনও নথি দিতে হবে না। স্রেফ ‘এনিউমেরেশন ফর্ম’ ভরলেই চলবে। এমনকী, তাঁদের সন্তানরাও বাবা-মায়ের নথি দেওয়ার হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছেন। তবে নিজেদের নাগরিকত্বের প্রমাণ আর এনিউমেরেশন ফর্ম ‘ফিল-আপ’ করতে হবে।

    শ্রীরামপুরের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “আমরা সর্বদা বলেছি কারও নাম যেন বাদ না যায়, নতুন নাম জোড়া হলে আমাদের মতো রাজনৈতিক দলকে জানানো হোক, রিভিউ নিয়ে সমস্য়া তৈরি হয়েছে।”

    প্রসঙ্গত, কমিশনের সংশ্লিষ্ট নির্দেশিকায় যাঁরা ১৯৮৭ সালের পরে জন্মেছেন, তাঁদের মা-বাবার জন্ম তারিখ ও জন্মস্থান সংক্রান্ত তথ্য় দেওয়ার শর্ত ছিল। এখন যদিও তা থেকে কমিশন কিছুটা সরে এসেছে। সাংসদ কল্য়াণ বলেছেন, এদিন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে কর্তারা বারবার বলেছেন, তৃণমূলের দাবি ‘বিবেচনা’ করে দেখা হবে। কল্যাণ ব্যানার্জী বলেছেন, “১৯৮৭ সালে নাম থাকলেও যে হবে না শোনা যাচ্ছিল, কমিশনের ওই সিদ্ধান্ত থেকে ওনারা কিছুটা সরে এসেছেন। আমরা বলেছি ‘বেস লেভেল হওয়া উচিত ২০২৪’, ওনারা বলেছেন বিবেচনা করব।”

    অর্থাৎ এখন শুধুমাত্র ২০০৩ সালের ভোটার তালিকায় নাম আছে উল্লেখ করলেই চলবে। তাছাড়া এখন খসড়া তালিকা তৈরি হচ্ছে। যাদের কাছে কোনও ডকুমেন্ট নেই, তারাও ‘এনিউমেরেশন ফর্ম ‘‘ফিল-আপ’ করতে পারবে। তবে যখন ফাইনাল তালিকা তৈরি হবে, তার আগে বুথ লেভেল অফিসারকে নথি দেখাতে হবে। নির্বাচন কমিশনের মতে, এই ভোটার তালিকা শুদ্ধিকরণের মধ্যে কোনও বিতর্ক নেই। সংবিধানের ৩২৬ অনুচ্ছেদ মোতাবেকই এই কাজ করা হচ্ছে। রাজ্যের কোনও ভোটারই যাতে ভোটাধিকার থেকে বাদ না পড়ে, সেই লক্ষ্যে এই উদ্যোগ। একই সঙ্গে কোনও অবৈধ ভোটারের নাম যাতে তালিকায় না থাকে, তা সুনিশ্চিত করা হবে।

    উল্লেখ্য, পূর্বে মহারাষ্ট্র, দিল্লি এবং হরিয়ানার নির্বাচনের আগেও একাধিকবার বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সে কথাও এদিন কমিশনের কর্তাদের মনে করিয়েছেন তৃণমূলের এই প্রতিনিধিদল। তাঁরা প্রশ্ন করেছেন, কী করে ভোটের তিন থেকে চার মাস আগে বড় অংশের ভোটারের নাম যোগ হয়ে যাচ্ছে ভোটার তালিকাতে? কমিশন বলেছে, “নমিনেশন জমা দেওয়ার দিন পর্যন্ত ভোটার লিস্টে নাম তোলা যায়, তারপর তোলা যায় না। অর্থাৎ ভোটের মাত্র ২৪ দিন আগে নাম তোলা যায় না, আমরা বলি এটাও অসুবিধা তৈরি করছে। আমরা বলছি ১৮ বছর বয়স বা ২১ বছর বয়সের ভোটার নিয়ে সমস্যা নেই। কিন্তু ৫০-৬০ বছরের ৪০ হাজার ভোটার ঠিক ভোটের আগের সময় কী করে হয় ! এই জায়গায় ওরা বলছে, ওরা গুরুত্ব সহকারে এই সব পয়েন্টগুলি বিবেচনা করছেন।”

    প্রসঙ্গত বছর ঘুরলেই বিধানসভা ভোট। তার আগে ভোটার তালিকা সংশোধন থেকে একাধিক প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। সংশোধনের কাজ করতে গিয়ে বেশ কয়েকটি নয়া নির্দেশিকা চালু করেছিল জাতীয় নির্বাচন কমিশন। প্রতিটি রাজ্যকে সেই মর্মে নির্দেশ পাঠানো হয়।  এর আগে ভোটার তালিকা সংশোধন থেকে শুরু করে ভুয়ো এপিক সংক্রান্ত সতর্কবার্তা-সহ একাধিক দাবি নিয়ে একাধিকবার দিল্লিতে নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছিল রাজ্যের শাসকদলের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল।

    তবে এবার বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কমিশনের সেসব নির্দেশিকা নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন। তাঁর মতে, যুক্তিহীন এবং জটিল ছিল সে সব নির্দেশাবলি। তার প্রতিবাদও করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই চাপে পড়ে কমিশন জটিলতা এড়াতে দু, একটি নির্দেশিকা প্রত্যাহার করে। তার মধ্যে অন্যতম, ১৯৮৭ থেকে ২০০৪ সালে জন্মানো ব্যক্তিদের ফর্ম পূরণের সময় বাড়তি কোনও নথি দিতে হবে না। আমজনতার কাছে নিঃসন্দেহে তা বড়সড় স্বস্তি।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)