মোদী-দিদির বঙ্গ ‘সেটিং’ তত্ত্বের জবাবে বিকল্প উদাহরণ দিতে শুরু করল বিজেপি, বিধানসভা ভোটের আগে নতুন ভাষ্য তৈরি?
আনন্দবাজার | ০২ জুলাই ২০২৫
সিপিএমের তোলা মোদী-দিদি ‘সেটিং’-এর অভিযোগ বঙ্গের রাজনৈতিক তর্কবিতর্ক মাঝেমধ্যেই বিজেপি-কে বেকায়দায় ফেলে। নরেন্দ্র মোদী এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে সত্যিই কোনও ‘সেটিং’ আছে কি না, ‘কেন্দ্রে মোদী-রাজ্যে দিদি’ ফর্মুলায় বঙ্গের রাজনীতিতে কোনও নেপথ্য সমীকরণ তৈরি করে রাখা হয়েছে কি না, সেই চর্চা মাঝেমধ্যেই শুরু হয়। বিজেপি সে তত্ত্ব নস্যাৎ করার চেষ্টা লাগাতার করে থাকলেও কোনও জুতসই পাল্টা ভাষ্য তারা এখনও খাড়া করতে পারেনি।
সেই আবহেই সদ্যসমাপ্ত কালীগঞ্জ উপনির্বাচনের প্রচারপর্বে বিজেপি নেতৃত্ব ‘সেটিং’ তত্ত্বের ‘জুতসই’ জবাব খুঁজে পেয়েছেন বলে দলের কর্মীদের একাংশ মনে করছেন। তাঁদের আশা, ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে সেই তত্ত্বকে ভাষ্যে পরিণত করা যাবে। একই সঙ্গে তাঁরা মনে করছেন, ওই ভাষ্য তৈরিই বিজেপি-র কাছে আসল চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে।
গত ১৯ জন নদিয়ার কালীগঞ্জ বিধানসভার উপনির্বাচন ছিল। সেখানে প্রচার চলাকালীন সাংগঠনিক প্রস্তুতি সুনিশ্চিত করতে রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) অমিতাভ চক্রবর্তী কালীগঞ্জে গিয়েছিলেন। সেখানে ‘সেটিং’ তত্ত্ব নিয়ে তাঁকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছিলেন বিজেপিরই এক কর্মী। একটি মণ্ডলের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন অমিতাভ। সেখানে ওই কর্মী তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘চায়ের দোকানে সকলে বলে, দিদি-মোদি সেটিং রয়েছে। এই প্রচারে আমাদের খুব অসুবিধা হয়। আমরা মানুষকে বোঝাতে পারি না।’’
তখনই অমিতাভ ওড়িশার উদাহরণ তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের আগে তিনি ওড়িশায় বিজেপির সংগঠনের দায়িত্বে ছিলেন। সেখানকার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক প্রতি মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করতেন এবং তাঁর জন্য প্রভু জগন্নাথের প্রসাদ নিয়ে যেতেন। সকলে বলতেন, নবীন-মোদী সেটিং। কেন্দ্রে মোদী, রাজ্যে নবীন। সেই সূত্রেই অমিতাভ বলেন, ‘‘ওড়িশায় তখন অনেকেই বলতেন, যত দিন নবীন জীবিত, তত দিন বিজেপি ওড়িশায় ক্ষমতায় আসবে না। কিন্তু বিজেপি তার বিজয় সংকল্পে অবিচল ছিল। ওড়িশায় নবীনকে সরিয়ে বিজেপি সরকার গড়ে প্রমাণ করেছে, সেটিংয়ের প্রচার অসত্য ছিল। পশ্চিমবঙ্গেও তা প্রমাণিত হবে।’’
‘সেটিং’ তত্ত্ব নস্যাৎ করতে এমন উদাহরণ বিজেপির তরফে এর আগে শোনা যায়নি। এত দিন ওই সংক্রান্ত প্রশ্নের মুখে পড়লে তৃণমূলের সঙ্গে তাঁদের নানা সংঘাতের ঘটনাকে ‘সেটিং’ না-থাকার প্রমাণ হিসেবে বিজেপি কর্মীরা তুলে ধরতেন। সিবিআই-ইডির অভিযানের কথা বলতেন। হিসাবের অভাবে বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা আটকে দেওয়ার কথাও মনে করাতেন। রাজ্য জুড়ে বিজেপি কর্মীদের উপরে তৃণমূলের ‘অত্যাচারের’ উদাহরণ দিতেন। কিন্তু কোনও নিশ্চিত প্রমাণ তাঁদের কাছে ছিল না। কালীগঞ্জে অমিতাভ সেই ‘প্রমাণ’ দিতে পেরেছেন বলে বিজেপির অনেকে মনে করছেন।
বঙ্গভোটের ফল নির্ধারণে ‘সেটিং’ তত্ত্বের বিন্দুমাত্র ভূমিকা থাকবে না বলে রাজ্য বিজেপি-র প্রধান মুখপাত্র তথা সাংসদ শমীক ভট্টাচার্যের দাবি। অমিতাভের উদাহরণকে ‘যোগ্য’ বলেই শমীক মনে করছেন। কিন্তু পাশাপাশিই তাঁর মতে, সিপিএমের তৈরি তত্ত্ব ২০২৬ সালের ভোটে প্রাসঙ্গিক থাকবে না। তাঁর কথায়, ‘‘তৃণমূলকে সরাতে যদি কেউ পারে, সেটা বিজেপিই পারবে, এ কথা পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি মানুষ জানেন। কে কী মনগড়া তত্ত্ব খাড়া করছেন, তার কোনও প্রভাব ২০২৬ সালের ভোটে পড়বে না।’’
প্রত্যাশিত ভাবেই এই প্রসঙ্গে তৃণমূলেরও প্রায় একই সুর। দলের রাজ্য সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদারের কথায়, ‘‘এমন বিভিন্ন কাগুজে তত্ত্ব খাড়া করে কি ভোট হয়? কোনও দলের সঙ্গে কোনও দলের প্রকাশ্য সমঝোতা বা জোট থাকলে অন্য কথা। কিন্তু তা না থাকলে কার সঙ্গে কার অন্তর্নিহিত বোঝাপড়া রয়েছে, সে সব গল্প শুনিয়ে মানুষের ভোট নেওয়া যাবে?’’ জয়প্রকাশ বলছেন, ‘‘নিজেদের শক্তিতে জনগণের মন জয় করার ক্ষমতা যে সব দলের নেই, তারা অন্য দল সম্পর্কে কিছু কুৎসা করে নেতিবাচক ভোট জোগাড়ের চেষ্টা করে। সিপিএমের ‘সেটিং’ তত্ত্বকে তার চেয়ে বেশি কিছু বলে আমি মনে করি না। পশ্চিমবঙ্গে এমন তত্ত্বের উপরে কখনও ভোট হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না।’’
‘সেটিং’ তত্ত্বের ‘জনক’ সিপিএম কী বলছে? দলের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য, ‘‘অমিতাভ চক্রবর্তী যে কথা বলেছেন, সেটা কোনও পাল্টা তত্ত্বই নয়! এটা আসলে আমাদের তত্ত্বকেই আরও প্রতিষ্ঠা দেওয়া।’’ তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘ওড়িশায় বিজেডি বা বিজেপি তো পরস্পরের বিরুদ্ধে কোনও রাজনৈতিক লড়াই লড়েইনি। নবীনের সঙ্গে মোদী সুসম্পর্ক রেখে গিয়েছেন। আর সংসদে বিভিন্ন বিল পাশের ক্ষেত্রে সরকারকে বিজেডি সমর্থন করে গিয়েছে।’’ সেলিমের কথায়, ‘‘বিজেপি এ ভাবে অনেক দলকে গিলে খেয়েছে। যত ক্ষণ বিজেপির মনে হয়েছে, এই ভাবে চালানো দরকার, তত ক্ষণ বিজেডি ক্ষমতায় থেকেছে। যখন বিজেপি বুঝেছে যে, এ বার একার ক্ষমতাতেই সব করতে পারবে, তখনই বিজেডিকে গিলে খেয়েছে।’’
পশ্চিমবঙ্গেও সেই ঘটনাই ঘটতে চলেছে বলে সেলিমের অভিমত। তিনি বলেন, ‘‘এ রাজ্যে তৃণমূলকে বিজেপিই ক্ষমতায় রেখে দিয়েছে। যাতে বামেরা সরকারে না আসতে পারে। এক দিকে তৃণমূলকে টিকিয়ে রাখছে, অন্য দিকে নিজেরা শক্তিবৃদ্ধি করছে। যখন বুঝবে, তৃণমূলকে টিকিয়ে রাখার আর প্রয়োজন নেই, তখন তাদের সরিয়ে দেবে। আর তৃণমূলেরই একটা অংশ তখন বিজেপিতে জুড়ে যাবে।’’ সেলিম উদাহরণ দিয়েছেন দিল্লির। তাঁর কথায়, ‘‘দিল্লিতেও বিজেপি একই ছকে ক্ষমতা দখল করেছে। দিল্লির ক্ষেত্রে আপ তবু কোনও কোনও বিষয়ে বিজেপির নীতির বিরোধিতা করত। তাতেও টিকে থাকতে পারল না। আর পশ্চিমবঙ্গে তো তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির কোনও রাজনৈতিক বিরোধই নেই। বিজেপির লোকজনকে তৃণমূল ব্যক্তিগত আক্রমণ করে। কিন্তু নীতিগত কোনও বিষয়ে বিরোধিতা করে না।’’