ঘটা করে বনসৃজন, বছর শেষে সিংহভাগই ‘মৃত’, মনিটরিং কমিটির রিপোর্টে ‘পুওর পারফরমেন্স’
বর্তমান | ০৩ জুলাই ২০২৫
পিনাকী ধোলে, পুরুলিয়া: ঘটা করে প্রতি বছরই বনসৃজন হয় পুরুলিয়ায়। বনসৃজনে খরচ হয় কোটি কোটি টাকা। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত কতগুলি গাছ বাঁচে? বনমহোত্সবের প্রাক্কালে এই প্রশ্নই তুলতে শুরু করেছেন জেলার সাধারণ মানুষ থেকে পরিবেশপ্রেমীরা।
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে বনদপ্তরের ‘মনিটরিং বিভাগের’ বিগত কয়েক বছরের রিপোর্টের দিকে চোখ বোলালেই হবে। সেই রিপোর্টে জেলার বনসৃজন নিয়ে ব্যাপক অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। বিগত বছরগুলিতে পুরুলিয়া জেলার হুড়া, কাশীপুর, পুরুলিয়া-পাড়া, রঘুনাথপুর, পুঞ্চা সহ একাধিক রেঞ্জের কয়েকশো হেক্টর জমিতে বনসৃজন হয়েছে। বেশিরভাগ জায়গাতেই চারা গাছের উপস্থিতি সন্তোষজনক নয় বলে জানিয়েছে মনিটরিং বিভাগ। জায়গার নাম উল্লেখ করে পাশে লাল কালির দাগ মার্ক করে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, বনসৃজনের অবস্থা ‘সঙ্গীন’।
গত বছরেই হুড়া রেঞ্জের করণডি, ইচামারা, কাশীপুর রেঞ্জের পাইঞ্জা, জগন্নাথডি, পুঞ্চা রেঞ্জের সৌরাং, চোকিয়া, পুরুলিয়া-পাড়া রেঞ্জের ফুসরাবাদ, বাগালিয়া, কোটশিলা রেঞ্জের চিতমু, খটঙ্গা সহ একাধিক জায়গায় বনসৃজন হয়েছে। সেইসব জায়গায় বর্তমানে জীবিত চারা গাছের উপস্থিতি মোটেই সন্তোষজনক নয়। এছাড়াও ফরেস্ট এক্সটেনশন বিভাগের তরফে বরাবাজারের টকোরিয়া থেকে খাড়িপাহাড়ী, পাড়ার ফুসরাবাদ থেকে আড়িতা, পুরুলিয়া-২ ব্লকের খাটরা থেকে মৌতড় পর্যন্ত যে বনসৃজন করা হয়েছিল, তার সিংহভাগই ‘মৃত’!
ফরেস্ট এক্সটেনশন বিভাগের তরফেই ২০২২-’২৩ সালে কেন্দ্রের ‘নামামি গঙ্গে’ প্রকল্পে পুরুলিয়ার ছরড়া থেকে আনারা পর্যন্ত প্রায় ১৯ কিলোমিটার রাস্তার দু’ধারে বনসৃজন করা হয়েছিল। বর্তমানে গাছের অস্তিত্ব চোখে দূরবীন দিয়ে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর!
অথচ এইসব গাছের তিন বছর পর্যন্ত রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ কোটি কোটি টাকা পায় বনদপ্তর। শুধু তাই নয়, যেসব এলাকায় বনসৃজন হয়, সেইসব এলাকায় বন পাহারার জন্যও ওয়েজ ফান্ড থেকে টাকা খরচ হয়। যদিও অভিযোগ, রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যা খরচ, খাতায় কলমে সেই খরচই দেখানো হয় সরকারকে। বাস্তবে ‘মৃত’ গাছের রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় বলে অভিযোগ।
প্রসঙ্গত, আমাদের রাজ্যে মূলত রাজ্য সরকারের তহবিল, গ্রিন ইন্ডিয়া মিশন, নামামি গঙ্গে, জাইকা প্রকল্পে বনসৃজন করা হয়। এছাড়াও রয়েছে কমপেনসেটরি অ্যাফরেস্টেসন(ক্যাম্পা)। অর্থাৎ, বৃক্ষ ছেদনের বিনিময়ে বৃক্ষ রোপণ। সব মিলিয়ে প্রতি বছর বনসৃজনে কোটি কোটি টাকা পায় বনদপ্তর। তাছাড়া কয়েক বছর আগে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পেও বৃক্ষরোপণ করা হতো। এনিয়েও জেলাবাসীর বিস্তর অভিযোগ প্রশাসনের কাছে জমা পড়েছে। প্রশ্ন উঠছে, বিপুল টাকা খরচ হলেও বনসৃজনের এই হাল কেন? এক্ষেত্রে তো বনসৃজনের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হচ্ছে। সবই কি তাহলে ‘আইওয়াশ’?
তবে, বনদপ্তরের কর্তাদের প্রচার, পুরুলিয়ার জঙ্গলের পরিমাণ বাড়ছে। সেই কারণেই পুরুলিয়ায় বাঘ আসছে। এত হরিণের দেখা মিলছে। যদিও পরিবেশবিদদের দাবি, বনের সংখ্যা কমছে বলেই লোকালয়ে বাঘ, হরিণ চলে আসছে।
পুরুলিয়া বনদপ্তরের ডিএফও অঞ্জন গুহর দাবি, আমরা তো কখনই চাই না বনসৃজন সহ আনুষঙ্গিক কাজ নিয়ে কোনও অভিযোগ উঠুক। আমরা সব কাজই ভালোভাবে করার চেষ্টা করি। জেলা পরিষদের বনভূমি কর্মাধ্যক্ষ জয়মল ভট্টাচার্য বলেন, বনসৃজনের পর গাছের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে আমার কাছেও বিস্তর অভিযোগ এসেছে। আমি নিজেও কয়েকটা জায়গা পরিদর্শন করে সন্তুষ্ট হতে পারিনি। সামনের বছর থেকে যাতে এই ধরনের অভিযোগ না ওঠে, তা দেখা হবে।