• কার ফোনে কী! ভয়ে সিঁটিয়ে TMCP
    এই সময় | ০৩ জুলাই ২০২৫
  • ‘গা ছম ছম, কী হয় হয়!’

    নব্বইয়ের দশক কাঁপানো এই গান এখনও যেন পুরোনো হয়নি। দক্ষিণ কলকাতার আইন কলেজে গণধর্ষণের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) নেতা মনোজিৎ মিশ্র গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে সংগঠনে অনেকেরই ‘গা ছমছম’ করতে শুরু করেছে! কেন?

    সংগঠন সূত্রের দাবি, মনোজিৎ টিএমসিপি-র একাধিক নেতার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ইতিমধ্যে অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে, এর আগে মনোজিতের বিরুদ্ধে একাধিকবার গুরুতর অভিযোগ উঠলেও এই প্রভাবশালী টিএমসিপি নেতারাই মনোজিৎকে আড়াল করার চেষ্টা করেছেন।

    গণধর্ষণের মামলায় মনোজিৎ গ্রেপ্তার হওয়ার পরে তার মোবাইল ইতিমধ্যেই পুলিশ সিজ় করে ফরেন্সিকে পাঠিয়েছে। এর আগেই জানা গিয়েছিল মনোজিতের বিকৃত মানসিকতার কথা, যেখানে অনেক তরুণীর শরীরের বিভিন্ন অংশের ছবি, ভিডিয়োর পাশাপাশি যাদের সে বা তার দলবল মারধর করত, সেই ভিডিয়োও তুলে রাখত মোবাইলে।

    অনেককে সেই ছবি ও ভিডিয়ো সে শেয়ারও করেছে। ফলে সেই ছবি, ভিডিয়ো অথবা কল রেকর্ডিং এখন কার কার কাছে পৌঁছেছে, সেটাই মূল চিন্তা টিএমসিপি-র এই নেতা-কর্মীদের।

    সূত্রের দাবি, তাঁদের অনেকেই এখন মোবাইলে হন্যে হয়ে খুঁজছেন তাঁদের কাছে মনোজিতের পাঠানো কী ছবি, ভিডিয়ো, চ্যাট, কল রেকর্ডিং বা স্ক্রিনশট আছে।

    সূত্রের খবর, সম্প্রতি টিএমসিপি-র এক প্রাক্তন নেতার কাছে ফোন এসেছিল বর্তমানে সংগঠনের রাজ্যস্তরের এক শীর্ষ নেতার। গভীর রাতে ওই প্রাক্তন নেতাকে ঘুম থেকে তুলে ওই রাজ্যস্তরের নেতা বলেন, ‘হ্যাঁ রে, আমার সঙ্গে তো মনোজিতের অনেক কথাবার্তা হতো। মনোজিৎ কি তোকে এমন কোনও কথাবার্তার স্ক্রিনশট বা কল রেকর্ডিং কিছু পাঠিয়েছিল? থাকলে আমাকে দে আর তুইও ডিলিট করে দে।’

    এটা শুনে আকাশ থেকে পড়েন ওই প্রাক্তন নেতা। তিনি পাল্টা বলেন, ‘আমি তো এক বছর হতে চলল সংগঠন ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি। ওই সব কি কেউ নিজের কাছে রেখে দেয়?’ ওই রাজ্যস্তরের নেতা তখন জানতে চান, ‘তা হলে কার কাছে আছে সাজেশন দে...!’

    টিএমসিপি-র দক্ষিণ কলকাতার এক নেতা, যাঁর সঙ্গে মনোজিতের একাধিক ছবি ইতিমধ্যেই ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে, তিনিও এখন মনোজিতের পাঠানো ভিডিয়ো এবং কল রেকর্ডিং খুঁজে বেড়াচ্ছেন নিজের মোবাইলে।

    এই নেতার বিরুদ্ধেও মূলত এই মনোজিৎকে অনেক সময়ে ‘শেল্টার দেওয়া’র অভিযোগ উঠেছে। ওই নেতার ঘনিষ্ঠ এক ছাত্র বলেন, ‘দাদার হোয়াটসঅ্যাপে কোর মেম্বারদের নিয়ে একটা গ্রুপ আছে।

    সেখানে দিন কয়েক আগেই আমাদের কাছে নির্দেশ এসেছে, যার কাছে মনোজিতের সঙ্গে দাদার যা যা ছবি-ভিডিয়ো-কল রেকর্ডিং আছে সব গ্রুপে পোস্ট করতে হবে। আর নিজেদের মোবাইল থেকে সেই সব ডিলিট করে দিতে হবে। আমার কাছে কয়েকটা ছবি ছিল, গ্রুপে দিয়ে দিয়েছি।’

    আইন কলেজগুলির দায়িত্বে আছেন, এমন এক নেতাও খুঁজে চলেছে‍ন এমন ছবি–ভিডিয়ো। তিনি নিজেই বলছেন, ‘এই ছেলেটার (মনোজিৎ) স্বভাব ছিল যে কারও পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার। এখন ওর ফোনটা বাজেয়াপ্ত হয়েছে। ফরেন্সিকে গিয়েছে। কী থেকে কী হয়, আমিও তাই সব কিছু জোগাড় করে রাখছি। বিরোধীরা তৃণমূলের পিছনে লাগার জন্য বসে আছে। তাই আগে থেকে প্রস্তুত হওয়া ভালো।’

    এই নেতাদের অনেকে আবার নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন তাঁদের সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইল লক করে দেবেন কি না, তা নিয়ে। কয়েকজন আবার তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞের পরামর্শও নিচ্ছেন।

    যদিও টিএমসিপি–র রাজ্য সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য বুধবার বলেন, ‘কারা এ সব করছেন, আমার জানা নেই। আমরা মনোজিৎকে নিয়ে ভাবিত নই। বরং আমি সংগঠনের জেলা সভাপতিদের নির্দেশ দিয়েছি, মনোজিতের মতো এমন কীর্তিমান সংগঠনে কারা আছেন, তাঁদের চিহ্নিত করে তাঁদের বিরুদ্ধে ইমিডিয়েট ব্যবস্থা নিতে।’

    মনোজিৎকে পুলিশ গ্রেপ্তার করার পরে তাকে কলেজের অস্থায়ী কর্মীর চাকরি থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছে, সেখানে টিএমসিপি কি তাকে বহিষ্কার করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করেছে? টিএমসিপি-র মধ্যে থেকেই এই প্রশ্ন উঠছে।

    তৃণাঙ্কুরের বক্তব্য, ‘ও আমাদের কোনও পদে নেই। দক্ষিণ কলকাতায় ২০২২ সালে যে কমিটি তৈরি হয়েছিল, সেখানেও মনোজিৎ ছিল না। ওই কলেজেও কোনও ইউনিট নেই। ফলে ওকে আলাদা করে বহিষ্কার ঘোষণা করার কোনও প্রয়োজন নেই।’

    এই অবস্থায় টিএমসিপি-রই প্রাক্তন নেতা প্রান্তিক চক্রবর্তী মুখ্যমন্ত্রী–সহ প্রশাসনের একাধিক কর্তাব্যক্তিকে বুধবার ই–মেল করে আইন কলেজগুলির সুরক্ষার জন্য বেশ কিছু দাবিদাওয়া জানিয়েছেন।

    যার মধ্যে রয়েছে, ল কলেজগুলির সুরক্ষার জন্য আলাদা গাইডলাইন, ছাত্রীদের জন্য গ্রিভান্স সেল তৈরি, ছাত্র সংসদে ছাত্র ও ছাত্রীদের সমান সমান প্রতিনিধিত্ব, ছাত্র–ভর্তির সময়ে অ্যান্টি র‌্যাগিংয়ের মতো অ্যান্টি মলেস্টেশন, অ্যান্টি রেপ— হলফনামা নেওয়া প্রভৃতি।

  • Link to this news (এই সময়)