• ওরা অত্যন্ত প্রভাবশালী! আদালতে পুলিশের তকমায় প্রশ্ন
    এই সময় | ০৩ জুলাই ২০২৫
  • দক্ষিণ কলকাতার আইন কলেজে গণধর্ষণের মামলায় গ্রেপ্তারির পরে টিএমসিপি নেতা সম্পর্কে এমনই ‘মূল্যায়ন’ কলকাতা পুলিশের তদন্তকারীদের। ধৃতদের ফের নিজেদের হেফাজতে নেওয়ার জন্য মঙ্গলবার আলিপুর আদালতে যে রিমান্ড পিটিশন জমা দিয়েছে, তাতে এ কথা স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে।

    যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, অভিযুক্ত জামিন পেলেই নির্যাতিতা ও মামলার সাক্ষীদের ভয় দেখাতে পারে, তথ্যপ্রমাণ লোপাট করতে পারে, গা ঢাকা দিতে পারে এবং তদন্তকে প্রভাবিত করতে পারে।

    সাম্প্রতিক অতীতে শিক্ষা দুর্নীতিতে ধৃত রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অথবা গোরু পাচার মামলায় ধৃত অনুব্রত মণ্ডল সম্পর্কে এমন ‘প্রভাবশালী’ শব্দটি ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই বা ইডি-কে।

    মনোজিৎও যে যথেষ্ট ‘প্রভাবশালী’, তা কলকাতা পুলিশের তরফে লিখিত ভাবেই আদালতে জানানোটা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন আইনজ্ঞদের একাংশ।

    আর এই দাবির সূত্র ধরেই উঠে আসছে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তা হলো, গণধর্ষণের মামলায় মনোজিৎ গ্রেপ্তার হয়েছে ঠিকই, তবে গত অন্তত দু’বছরে কলকাতার বেশ কয়েকটি থানায় তার বিরুদ্ধে অপহরণ, খুনের চেষ্টা, শ্লীলতাহানি, চুরি, পুলিশকে মারধরের মতো অভিযোগ উঠলেও তার এই ‘প্রভাব’–এর জন্যই কি অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি অথবা গ্রেপ্তার করা হলেও দ্রুত জামিন পেয়ে গিয়েছে সে?

    কয়েকটি ক্ষেত্রে ওই আইন কলেজের একাধিক ছাত্রী তার ‘শিকার’ হলেও ভয়ে পুলিশে অভিযোগ জানাতে পারেননি। অনেক ছাত্র তার দলবলের হাতে বেধড়ক মার খেলেও পুলিশে যাননি। এখন মনোজিৎ গ্রেপ্তার হওয়ার পরে সেই ছাত্রছাত্রীদের অনেকে মুখ খুলছেন।

    এখন কি তা হলে ‘প্রভাবশালী’ মনোজিতের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া আগের মামলাগুলি নিয়ে এগোবে পুলিশ?

    লালবাজারের এক কর্তা বুধবার জানান, মনোজিতের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক অতীতে ১১টি এফআইআর হয়েছে গড়িয়াহাট, হরিদেবপুর, কালীঘাট, কসবা, টালিগঞ্জ-সহ শহরের একাধিক থানায়। এর মধ্যে শ্লীলতাহানি, পুলিশকে মারধর, হুমকি–সহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে।

    যদিও কলেজ সূত্রে জানা গিয়েছে, ১১ নয়, মনোজিতের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া লিখিত অভিযোগের সংখ্যাটা অন্তত ২০। বার চারেক সে গ্রেপ্তারও হয়েছিল। কিন্তু খুব অল্প সময়েই জামিন পেয়ে বাইরে বেরিয়ে যায় সে। ফের শুরু করে ‘দাদাগিরি’।

    কলকাতা পুল‍িশের এক কর্তা বলেন, ‘মনোজিৎকে তিন–চার বার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারপরে সে আদালত থেকে জামিন পায়।’ কতগুলি কেসে কলকাতা পুলিশ চার্জশিট দিয়েছে?

    ওই কর্তার দাবি, ‘১১টি মামলাতেই মনোজিতের বিরুদ্ধে চার্জশিট হয়েছে।’ কসবায় চলতি বছরে জুলাই মাসে মনোজিতের বিরুদ্ধে পুলিশকে মারধরের অভিযোগ ওঠে। একটি এটিএমে ঢুকে গার্ডকে মারধর করার পরে ওই গার্ড পুলিশকে খবর দিলে কলকাতা পুলিশেরই এক অফিসারকে বেধড়ক মারধর করে এই গুণধর।

    পরে থানায় তুলে নিয়ে যাওয়ার পরেও সে গালিগালাজ করে পুলিশকর্মীদের। গ্রেপ্তারির পর দিন সকালেই জামিন পেয়ে যায় মনোজিৎ। তার জামিন বাতিল করতে কি কলকাতা পুলিশ উচ্চ আদালতে গিয়েছিল?

    ওই পুলিশকর্তার জবাব, ‘উচ্চ আদালতে যাওয়া হয়েছিল কি না, এখনই জানা নেই। তবে পুরোনো যত মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে, সেগুলি খতিয়ে দেখছে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ।’

    আদালতে পুলিশ জানিয়েছে, মনোজিতের মতো এ রকম অভিযুক্ত যদি এত ঘৃণ্য অপরাধ ঘটানোর পরেও জামিন পেয়ে যায়, তা হলে সমাজে ভুল বার্তা যাবে। যদিও পুলিশের একাংশের বক্তব্য, আগেই যদি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে চার্জশিট দিয়ে তার কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা যেত, তা হলে হয়তো এই গণধর্ষণের ঘটনা ঘটত না।

    মনোজিৎকে দেওয়া কলকাতা পুলিশের এই ‘প্রভাবশালী তকমা’ নিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপও চড়েছে। সিপিএম নেতা শতরূপ ঘোষের বক্তব্য, ‘পুলিশ একদম সঠিক কথাই বলেছে। মনোজিৎ অবশ্যই প্রভাবশালী। কিন্তু তার প্রভাব পুলিশের কার কার উপরে ছিল, কেন তাকে এর আগে মারাত্মক সব অভিযোগ পেয়েও ব্যবস্থা হয়নি সেটাও পুলিশকে বলতে হবে।’

    তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক তন্ময় ঘোষ বিরোধীদের কটাক্ষ করে বলেন, ‘এটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজত্ব বলেই অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করে জামিন যাতে না পায় তার ব্যবস্থা করেছে। অন্যত্র ধর্ষককে ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করা হয়। পুলিশ কেন মনোজিৎকে প্রভাবশালী বলেছে, সেটা পুলিশই বলতে পারবে।’

  • Link to this news (এই সময়)