• কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শমীকের পাশে থাকার বার্তা সুকান্ত এবং শুভেন্দুর, ঐক্যের সুরে তাল কাটল এক বারই!
    আনন্দবাজার | ০৩ জুলাই ২০২৫
  • মনোনয়ন জমা পড়েছিল একটিই। প্রত্যাশিত ভাবেই বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিক ভাবে শমীক ভট্টাচার্যকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সভাপতি হিসাবে ঘোষণা করে দিল বিজেপি। তাঁর সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল সায়েন্স সিটিতে। সেখানে রাজ্য বিজেপির শীর্ষ স্তরের নেতারা প্রায় সকলেই ছিলেন। শমীকের প্রসঙ্গে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং বিদায়ী রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এক সুরে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার বার্তাও দিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের সেই ঐক্যের সুরে তাল কেটেছে এক বারই। সুকান্ত তাঁর ভাষণে বেশ কয়েক বার যে নাম উচ্চারণ করেছেন, শুভেন্দু ভুল করেও সেই নাম মুখে আনেননি। তিনি দিলীপ ঘোষ। বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি। অনেকের মতে, সবচেয়ে সফলও বটে।

    অসীম ঘোষ থেকে শুরু করে রাহুল সিংহ, বৃহস্পতিবার শমীকের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতিরা সকলেই ছিলেন। ছিলেন না কেবল দিলীপ। তাঁকে ডাকা হয়নি। গত কয়েক দিন ধরে তাঁর সঙ্গে রাজ্য বিজেপির দূরত্বের যে সমীকরণ প্রকাশ্যে এসেছে, বৃহস্পতিবার তা আরও প্রকট হল। দিলীপকে এই অনুষ্ঠানে না-ডাকা নিয়ে বিজেপির অন্দরে একটা অংশের মধ্যে অস্বস্তি রয়েছে। সেই অস্বস্তিই আরও খানিকটা বাড়ল সুকান্ত-শুভেন্দুর ভাষণে।

    রাজ্য সভাপতি হিসাবে শমীকের নাম আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করার পর তাঁর হাতে শংসাপত্র তুলে দেন রবিশঙ্কর প্রসাদ। দলের পতাকা শমীকের হাতে দেন বিদায়ী সভাপতি সুকান্ত। মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি জানান, নতুন সভাপতিকে সব রকম ভাবে তিনি সহায়তা করবেন। দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে শমীকের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবেন। এ প্রসঙ্গেই অন্তত দু’বার দিলীপের নাম আসে সুকান্তের ভাষণে। তিনি বলেন, ‘‘চার বছর আগে এই রকম একটি অনুষ্ঠানে দিলীপদা সকলকে দিয়ে ‘সুকান্ত মজুমদার জিন্দাবাদ’ বলিয়েছিলেন। আমি আজ আপনাদের সকলকে ‘শমীক ভট্টাচার্য জিন্দাবাদ’ বলতে বলছি। ২০২৬-এর লড়াই শমীকদার নেতৃত্বে হবে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হবে।’’ সভাপতি হওয়ার পর রাহুলের হাত থেকে একসময়ে দিলীপ দলের পতাকা তুলে নিয়েছিলেন। তার পর দিলীপের হাত থেকে সেই পতাকা নেন সুকান্ত। এ ভাবেই বিজেপিতে পালাবদল ঘটে, ব্যাখ্যা করেছেন সুকান্ত। এর পরেই শুভেন্দু বলতে ওঠেন। তাঁর ভাষণে মঞ্চে উপস্থিত সকলের স্পষ্ট পরিচয়-সহ নাম শোনা গিয়েছে। প্রাক্তন সভাপতিদের কথা বলতে গিয়ে শুভেন্দু খুব স্পষ্ট ভাবে তিন জনের নাম করেন— অসীম, রাহুল এবং সুকান্ত। কিন্তু দিলীপের নাম এক বারও উচ্চারণ করেননি বিরোধী দলনেতা।

    বিজেপির ভিতরে বাইরে সুকান্ত-শুভেন্দুর সম্পর্কের বিষয়ে নানা রকম চর্চা এবং জল্পনা শোনা যায়। কিন্তু সভাপতি হিসাবে সুকান্তের বিদায়মঞ্চে শুভেন্দু শ্রদ্ধার সঙ্গেই সুকান্তের নাম নিয়েছেন। তাঁর প্রশংসা করেছেন। এমনকি, একটি বিষয়ে তিনি সুকান্তের সঙ্গে সহমতও পোষণ করেন। সুকান্ত ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর রাজ্য জুড়ে বিজেপি কর্মীদের উপর তৃণমূলের অত্যাচার এবং ভোটপরবর্তী হিংসার প্রসঙ্গে যে কথা বলেছিলেন, শুভেন্দু তার সঙ্গে একমত হয়ে বলেন, ‘‘আমি সুকান্ত মজুমদারের সঙ্গে একমত। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পরে মমতার সরকার আমাদের পার্টির বুথ স্তর, ওয়ার্ড স্তরের উপর নারকীয় অত্যাচার করেছিল, গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। ৫৭ জন শহিদ হয়েছিলেন দু’মাসে। এক লক্ষ কর্মী ঘরছাড়া হয়েছিলেন। সেই ভেঙে দেওয়া নীচের তলাকে দলের একনিষ্ঠ কর্মীরা নতুন করে তৈরি করেছেন।’’ কিন্তু সুকান্তের প্রশংসা করলেও দিলীপের প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়েছেন শুভেন্দু।

    শুভেন্দু এবং দিলীপের ‘মধুর’ সম্পর্কের কথা কারও অজানা নয়। ২০২১ সালের ভোটের আগে বিজেপিতে যোগ দেন শুভেন্দু। দিলীপ তখন রাজ্য সভাপতি। তাঁদের কেন্দ্র করেই বিজেপির অন্দরে ‘নবীন-প্রবীণ’ দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। কিছু দিন আগে দিলীপের বিয়ের সকালে তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়েছিলেন সুকান্ত-সহ বিজেপির নেতারা। শুভেন্দুকে সেখানে দেখা যায়নি। কিন্তু শুভেন্দু-দিলীপ দ্বন্দ্ব প্রকট হয় অতি সম্প্রতি দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধনের দিন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমন্ত্রণে ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলেন দিলীপ। সে দিনই কাঁথিতে শুভেন্দুর সভা ছিল। দিলীপ সেখানে যাননি। পরে সুকান্ত জানিয়ে দেন, দিলীপের দিঘায় যাওয়া দল অনুমোদন করছে না। কারণ দলগত ভাবে ওই অনুষ্ঠানে না-যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। দিলীপের যাওয়ার সিদ্ধান্ত ব্যক্তিগত। এমনকি, দিলীপ বিজেপি ছাড়তে চলেছেন বলে জল্পনাও তৈরি হয়েছিল সেই সময়ে। জল্পনা অবশ্য উড়িয়ে দিয়েছিলেন দিলীপ নিজে। কিন্তু দিঘায় যাওয়ার পর থেকে বিজেপির অন্দরে তাঁকে নিয়ে বিতর্ক আরও বেড়েছে। দিঘা থেকে ফেরার দিন তাঁর যে চা চক্র করার কথা ছিল, কর্মীদের বিক্ষোভে তা-ও ভেস্তে গিয়েছিল। তার পর থেকে বিজেপির অনেক গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে ডাক পাননি দিলীপ। দূরত্ব বেড়েছে। বিজেপি সূত্রে খবর, দলের একটা অংশ চেয়েছিল, শমীকের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দিলীপকে ডাকা হোক। কিন্তু তাঁকে যে শেষ পর্যন্ত ডাকা হয়নি, তা নিয়ে দলের অন্য অংশের মধ্যে কোনও অস্বস্তি নেই। একটি সূত্রের দাবি, দিলীপকে এই অনুষ্ঠানে ডাকার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেরই অনিচ্ছা ছিল।

    সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা দিয়েছেন শমীক। চাকরি বিক্রি, পরিযায়ী শ্রমিক, কেন্দ্রীয় প্রকল্পে বাধা প্রভৃতি প্রসঙ্গে তৃণমূল সরকারকে তুলোধনা করেছেন তিনি। তা প্রত্যাশিতই ছিল। তবে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে লক্ষ্য করে এই মঞ্চ থেকেই শুভেন্দু যে বার্তা দিয়েছেন, শমীকের কথায় তার সঙ্গে কিছুটা ফারাক স্পষ্ট। শমীক বলেছেন, ‘‘বিজেপির লড়াই এ রাজ্যের সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নয়। সংখ্যালঘুদের ঘরে যে ছেলেরা পাথর নিয়ে ঘুরছে, আমরা আসলে সেই পাথরটা কেড়ে নিয়ে হাতে বই ধরিয়ে দিতে চাই। ওদের তলোয়ার কেড়ে নিয়ে হাতে কলম ধরাতে চাই। আমরা চাই, দুর্গাপুজোর মিছিল এবং মহরমের মিছিল একই সময়ে পাশাপাশি হেঁটে যাবে, কোনও সংঘর্ষ ছাড়া। বাংলাকে রক্ষা করতে হবে।’’ বিজেপির নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘দলের পুরোনোরা মনে রাখবেন, নতুনেরা না এলে পার্টি বাড়বে না। পার্টিতে সকলেরই প্রয়োজন আছে। আমরা কুমোরটুলি থেকে অর্ডার দিয়ে লোক আনতে পারব না। আর নতুনেরা মনে রাখবেন, হার নিশ্চিত জেনেও পুরনোরা দলের পতাকা ধরে রেখেছিলেন। প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। তাই নতুন পুরোনো বলে কিছু নেই। মানুষের দরবারের থেকে বড় কিছু নেই। এ বার তাই ২০০ পার নয়, তৃণমূলকে একেবারে পরপারে পাঠিয়ে দেবে বিজেপি।’’
  • Link to this news (আনন্দবাজার)