বিজেপির সভাপতি বরণের মঞ্চে কালীঘাটের বিগ্রহের ছবি, বঙ্গের ‘নিজস্ব হিন্দুত্ব’ আমদানি? না কি নিশানা ‘কালীঘাটবাসিনী’কেই?
আনন্দবাজার | ০৩ জুলাই ২০২৫
পশ্চিমবঙ্গের জন্য ‘বাঙালি হিন্দুত্বে’ জোর দিতে চলেছে বিজেপি। শমীক ভট্টাচার্যকে বেছে নেওয়ার কারণ কী, তা ব্যাখ্যা করে বুধবার থেকেই বিজেপির একাংশের তরফে বলা শুরু হয়েছিল। বিস্তীর্ণ গ্রাম-মফস্সল বিজেপির সঙ্গেই রয়েছে, এবার তার পাশাপাশি শমীক ‘শহুরে, শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, ভদ্রলোক’ বাঙালির মন আরও বেশি করে স্পর্শ করবেন, এই মর্মে ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছিল। বৃহস্পতিবার বিজেপির নতুন রাজ্য সভাপতিকে বরণের মঞ্চ বুঝিয়ে দিল, বঙ্গে বদলে যাচ্ছে হিন্দুত্বের ‘ব্র্যান্ডিং’। শমীককে আনুষ্ঠানিক ভাবে সভাপতি ঘোষণা করার মঞ্চে শ্রীরামচন্দ্রের ছবি নয়, দেখা গেল কালীঘাট মন্দিরের কালীর বিগ্রহের ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। শমীকের নাম ঘোষিত হতে সেই ছবিই আরও বড় আকারে ভেসে উঠল মঞ্চের এলইডি পটভূমিতে।
বিজেপির যে কোনও মঞ্চে জনসঙ্ঘ (বিজেপির পূর্বসূরি) প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, দলের প্রধান তাত্ত্বিক দীনদয়াল উপাধ্যায় এবং ভারতমাতার ছবি থাকা আবশ্যিক। বৃহস্পতিবার সায়েন্স সিটির প্রদর্শনী ময়দানে হ্যাঙ্গার-আচ্ছাদিত মঞ্চেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কিন্তু যে দিকে সেই তিনটি ছবি রাখা ছিল, তার উল্টো দিকেই ফুল-মালায় সজ্জিত কালীর ছবিও ছিল। ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে, সে ছবি কালীঘাটের বিগ্রহের। বিজেপির কর্মসূচিতে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিও ওঠে মুহুর্মুহু। কিন্তু বৃহস্পতি-মঞ্চে শ্রীরামের পাশাপাশি মা কালীর নামেও জয়ধ্বনি শোনা গেল কর্মসূচির সঞ্চালক তথা পুরুলিয়ার সাংসদ জ্যোতির্ময় সিংহ মাহাতোর মুখে।
২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে বিজেপি কি বাংলার ‘নিজস্ব’ হিন্দুত্বের ‘মডেল’ আমদানি করল? দলীয় নেতৃত্ব এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দিচ্ছেন না। তবে কেউ কেউ ঘুরিয়ে যে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, তাতে বাঙালির নিজস্ব হিন্দুত্বে জোর দেওয়ারই আভাস ধরা পড়েছে। রাজ্য বিজেপির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক লকেট চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘মা কালী তো বাঙালির ঘরে ঘরে। সকালে-বিকেলে বাংলার ঘরে ঘরে মা কালীর নাম নেওয়া হয়। মা কালীর আশীর্বাদ চাওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির মঞ্চে মা কালীর ছবি থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক।’’ কিন্তু সেই ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা এত দিন কেন ঘটেনি, তার ব্যাখ্যায় লকেট যাননি।
নতুন সভাপতি শমীকের উত্তর আরও ঘোরানো, আরও ঊহ্য, ‘‘বিজেপি বাঙালিরই দল। বাঙালির হাতে এই দল তৈরি হয়েছে। বাংলা নিজের যে সব ঐতিহ্য, পরম্পরা নিয়ে গর্ব করে, বিজেপি সেই সব কিছুতেই গর্ব অনুভব করে।’’ পরের বাক্যেই রাজনীতি এবং ধর্ম থেকে আরও দূরে সরে গিয়ে শমীক বলছেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্রের বাংলা। নজরুল, মুজতবা আলি, মুজতবা সিরাজের বাংলা। তাঁদের প্রত্যেকের রচনায় আমাদের সুপ্রাচীন সভ্যতার নিজস্ব দর্শনের ছাপ। রবীন্দ্র পরবর্তী যুগে যাঁরা লিখেছেন এবং বাঙালির গর্ব হয়ে উঠেছেন, তাঁদের রচনাতেও উপনিষদের শিক্ষা এবং ভাবধারা। এটাই বাংলা, এটাই বাঙালিয়ানা। বিজেপি সেই বাঙালিয়ানাতেই বিশ্বাস করে।’’ অর্থাৎ, মঞ্চে কালীর উপস্থিতি হিন্দুত্বে ‘বাঙালিয়ানা’ যোগ করার লক্ষ্যে কি না, রাজ্য বিজেপির সভাপতি তা স্পষ্ট করতে চাননি। কিন্তু ‘বাঙালিয়ানা’ প্রসঙ্গ এড়াতেও পারেননি।
তৃণমূলের রাজ্য সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদারের অবশ্য বক্তব্য, ‘‘বিজেপির সভাপতি বরণের মঞ্চ ছিল বৈপরীত্য এবং সংশয়ে ঠাসা। এক দিকে শুভেন্দু অধিকারী শুধু হিন্দু-হিন্দু করলেন। অন্য দিকে, শমীক ভট্টাচার্য বললেন, দুর্গাপুজো আর মহরম একই সঙ্গে হবে। সেখানেই বোঝা গিয়েছে, দলের মধ্যে দৈন্য এবং সংশয় চরম পর্যায়ে। বোঝা গিয়েছে, ওদের নীতি এবং চিন্তাধারায় কোনও স্বচ্ছতা নেই।’’ তাঁর কথায়, ‘‘কালীঘাটের মা কালীর মুখ দেখিয়ে যে নাটকটা বিজেপি করেছে, সেটাও আর একটা সংশয়ময় রাজনৈতিক পদক্ষেপ। এত দিন রাম আর হনুমানের মুখ দেখিয়ে সারা বাংলা ঢেকে দেওয়া হয়েছে। মা কালীকে পাওয়া যায়নি। পরে জগন্নাথদেবকে কেন্দ্র করে বিভাজন তৈরি করা হয়েছে। দিঘার জগন্নাথ বড় না কি পুরীর জগন্নাথ? তৃণমূল সে সব ভেদাভেদ সরিয়ে ‘জয় জগন্নাথ’ স্লোগান তুলে ধরেছে। তাকে সামাল দিতেই কি কালীঘাটের মা কালীর মুখ আনতে হচ্ছে?’’
তবে অনেকে বলছেন, শুধু হিন্দুত্বে ‘বাঙালিয়ানা’ মেশানো নয়, এই ছবির অন্য ‘তাৎপর্য’ও রয়েছে। তা হল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘খাসতালুকে’ হানা দেওয়ার বার্তা। কালীঘাটের মন্দির মমতার নিজের পাড়ায় তো বটেই। বিভিন্ন শুভকাজের আগে মমতা কালীঘাটের এই বিগ্রহের সামনে গিয়ে দাঁড়ান, ভক্তিভরে পজো দেন। আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন। সম্প্রতি কালীঘাট মন্দির চত্বরের সংস্কার এবং মন্দিরে যাতায়াত মসৃণ করতে স্কাইওয়াকও তৈরি করিয়েছেন তিনি। সেই কালীঘাটের বিগ্রহকে সাক্ষী রেখেই কি মমতাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ছে বিজেপি?
রাজ্য বিজেপির আর এক সাধারণ সম্পাদক অগ্নিমিত্রা পালের জবাব, ‘‘বাংলা মানেই কালীঘাট আর দক্ষিণেশ্বর। আমাদের মঞ্চে মায়ের ছবি হয়তো আগে কখনও রাখা হয়নি। কিন্তু সর্বভারতীয় স্তরের নেতারা এলে আমরা কালীঘাটের মায়ের ছবি বা মূর্তিই উপহার দিই।’’ অতঃপর তাঁর সংযোজন, ‘‘কালীঘাটের মায়ের কৃপাতেই যেন কালীঘাটবাসিনী অশুভ শক্তির বিনাশ তথা বিসর্জন হয়!’’