নিজস্ব প্রতিনিধি, আসানসোল: গলিত লোহা বোঝাই ল্যাডেল (গলিত লোহা পবিবহণের বিশেষ পাত্র) ইস্পাত শ্রমিকদের কাছে সাক্ষাৎ মৃত্যু দূত। এই ল্যাডেল উল্টে ঝলসে গিয়ে কত শ্রমিকের যে প্রাণ গিয়েছে, তার কোনও ইয়ত্তা নেই। ইস্কো, ডিএসপিতেও একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটেছে। অবশেষে, সেই গলিত লোহা পরিবহণের প্রক্রিয়া নজরদারি চালাতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি আনল বার্নপুরে ইস্কো। সেইলের অধীনে থাকা এই কারখানায় চালু করা হয়েছে টর্পেডো ল্যাডাল মনিটরিং সিস্টেম (টিএলএমএস)। এই টেকনোলজিতে অত্যাধুনিক ক্যামেরা, জিপিএস, এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে ল্যাডেল পরিবহণের পুঙ্খানুপুঙ্খ নজরদারি চালানো হবে। ল্যাডেলের তাপমাত্রা পরিমাপ থেকে, তার সঠিক অবস্থান, ল্যাডেলের দেওয়াল কী অবস্থা রয়েছে, কোথায় লিকেজের সম্ভাবনা রয়েছে কিনা, তার সব তথ্য পৌঁছে যাবে কন্ট্রোল রুমে। কোনও রকম বিপদের আভাস থাকলেও ই-মেইল ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে সতর্কবার্তা পৌঁছে দেবে কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন স্তরে। এই আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে আশাবাদী শ্রমিক মহল। কারখানায় শ্রমিকরা আরও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কাজ করতে পারবেন। সেই সঙ্গে উৎপাদন বাড়বে, স্ক্র্যাপ সামগ্রীর পরিমাণ কমবে।
বৃহৎ ইস্পাত কারখানার ব্লাস্ট ফার্নেসে কয়লার সাহায্যে লৌহ আকরিক গলিয়ে গলিত লোহা পরিণত হয়। সেই গলিত লোহা ল্যাডেলের মাধ্যমে পরিবহণ করে নিয়ে যাওয়া হয় স্টিল মেল্টিং শপে (এসএমএস)। সেখানে একাধিক খনিজ পদার্থ যুক্ত করে তৈরি হয় স্টিল। এই পুরো প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ইস্কো, ডিএসপির মতো দৈত্যাকার ইস্পাত কারখানায় বিপুল ইস্পাত উৎপন্ন হয়। তাই গলিত লোহা ভর্তি ল্যাডেলগুলি পরিবহণ করার জন্য লোকো ব্যবহার করা হয়। কারখানার ভেতরেই লোকোর মাধ্যমে ল্যাডেলগুলিকে ব্লাস্ট ফার্নেস থেকে এসএমএসে নিয়ে আসা হয়। এখানেই সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। কখনও ট্র্যাকের ত্রুটির জন্য ল্যাডেল উল্টে যায়। গলিত লোহা ছিটকে পড়ে শ্রমিকদের বেঘোরে মৃত্যু হয়। বছর কয়েক আগেই এমনই একটি দুর্ঘটনায় ডিএসপিতে ৪ জন শ্রমিক মারা যান। ইস্কোতেও ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে ছ’জনের মৃত্যু হয়েছিল। অনেক সময়ে ল্যাডেলের প্রাচীর লিকেজ হয়ে গেলে গলিত লোহা গড়িয়ে পড়ে। তার জেরেও দুর্ঘটনা লেগেই থাকে। এবার সেখানেই বসল অত্যাধুনিক এই ব্যবস্থাপনা। চলতি সপ্তাহে যার সূচনা করেছেন ইস্কোর ইডি ওয়ার্কস দীপ্তেন্দু ঘোষ, উপস্থিত ছিলেন ইডি (প্রজেক্ট) সুরজিৎ মিশ্র।
ইস্কোর দাবি, টিএলএমএস-এ রয়েছে ৩৬০ ডিগ্রি থার্মাল ইমেজিং। তিনটি
আইআর বেসড ক্যামেরা। যেগুলি তাপমাত্রা পরিমাপ করবে। আরএফআইডি ও জিপিএস প্রযুক্তি ল্যাডেলের লাইভ লোকেশন ও মুভমেন্ট ট্র্যাকিং করবে। হট মেটাল ব্রেক আউট হয়ে ল্যাডেল থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা থাকলে বিপদ সংকেত পাঠাবে। এআই থার্মাল ডেটা বিশ্লেষণ করে কোন এলাকাটি রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন তার পূর্বাভাস দিয়ে দেবে। ব্লাস্ট ফার্নেসের কন্ট্রোল রুম থেকে পুরো বিষয়টি কেন্দ্রীয়ভাবে নজরদারি চালানোর সুবিধা রয়েছে।
ইস্কোর জনসংযোগ আধিকারিক ভাস্কর কুমার এদিন বলেন, ‘প্রযুক্তিটি ব্যবহারের ফলে দুর্ঘটনা কমবে। উৎপাদনও বাড়বে।’ ইস্কোর আইএনটিইউসি নেতা হরজিৎ সিং বলেন, ‘নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে শ্রমিকদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে। কর্তৃপক্ষের এই পদক্ষেপে আমরা খুশি।’ সিটু নেতা সৌরেন চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল ল্যাডেল পরিবহণে শ্রমিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা হোক। অবশেষে তা হল।’ ডিএসপির শ্রমিক নেতা রজত দীক্ষিত বলেন, ‘আমরা দাবি জানিয়েছি, ইস্কোর মতো ডিএসপিতেও এই প্রযুক্তি চালু করতে হবে।’