• ৪২ পাচকের তৈরি জগন্নাথের ৫৬ ভোগ! ফি দিন হাজার জনের পাতে পড়ছে মহাপ্রসাদ
    প্রতিদিন | ০৫ জুলাই ২০২৫
  • সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: সুদূর নদিয়া থেকে নিয়ে আসা হয়েছে ৪২ জন পাচক। প্রত্যেকটা পাচকের দু’জন করে সহযোগী। সবে মিলিয়ে প্রায় ১০০ জনের হাতে তৈরি হয় মহাপ্রভু জগন্নাথের ৫৬ ভোগ। শুধু দুপুরের ৫৬ পদের রাজভোগই নয়, ভোর সাড়ে চারটে থেকে রাত আটটা পর্যন্ত আরও পাঁচটা ভোগ হয়। সেই ভোগের রান্নাও করেন ওই পাচকরা। সেইসঙ্গে প্রতিদিন হাজার খানেক ভক্ত খান পাত পেড়ে। রথযাত্রার দিন থেকেই প্রভুর ভোগের এমন বাহার চলছে পুরুলিয়ার হুড়ায়। শনিবার, উলটোরথ পর্যন্ত এমনই চলবে। এভাবে আটদিন মহাপ্রভু জগন্নাথকে সেবা করে চলে হুড়া রথ মহোৎসব কমিটি।

    এবার হুড়ার এই রথযাত্রা উৎসব ১১ বছরে পা দিয়েছে। অতীতে বাঁকুড়ার ঝাঁটিপাহাড়ি জগন্নাথ মন্দির থেকে মহাপ্রভু জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রাকে এই হুড়ায় নিয়ে এসে রথে চাপানো হতো। এবার অবশ্য তা হয়নি। সেখান থেকে আসা বিগ্রহ নিয়ে আসা হয়েছিল হুড়ার সুভদ্রা কলোনিতে। সেখানেই বিশাল জগন্নাথ মন্দির নির্মাণের কাজ চলছে। সেখান থেকেই জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রা রথে অধিষ্ঠিত হন। এরপর তিন কিলোমিটার দূরে পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু সরণিতে মাসির বাড়িতে বেড়াতে যান ভগবান জগন্নাথ।সঙ্গে বলভদ্র, সুভদ্রাও। আটদিনই মহাপ্রভুর সেবা দেখতে রীতিমতো ভিড় উপচে পড়ছে জগন্নাথের মাসির বাড়িতে।

    এই রথযাত্রার প্রধান পুরোহিত কমলনয়ন দাসের কথায়, “পুরীর জগন্নাথ দেবের রথের আদলে ইসকনের নির্দেশে মায়াপুরে রথ তৈরি করা হয়।ফি বছর পুরী থেকে রথের লাল ধ্বজা নিয়ে আসা হয়। উলটোরথের পরে তা জগন্নাথ দেবের চরণে অর্পণ করা হয়ে থাকে। যেভাবে পুরীতে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন প্রভু জগন্নাথকে ৫৬ ভোগ অর্পণ করেছিলেন, আমরা সেভাবেই এখানে করে থাকি।”

    জগন্নাথদেবের সেই ৫৬ ভোগে কী না থাকে? গোবিন্দভোগ চালের সাদা ভাত ছাড়াও থাকে ঘি ভাত। থাকে বাসন্তী পোলাও, তেতো ডাল, সবজি ডাল। সঙ্গে নানান ভাজা, আলুপটল, কাঁকরোল, বেগুন, কুমড়ো এমনকী বেগুনিও!এছাড়া একাধিক রকমের চপ। কুমড়ো, ক্যাপসিকাম দিয়ে তা বানানো হয়। এছাড়া বড়াও থাকে বেশ কয়েক রকমের। থাকে বিউলি ডাল, মাস কলাই, মোচা, সজনে পাতা, বাঁধাকপির বড়া। সবজিতে কচুর লতি ভাপা, পটল ভাপা, কুমড়ো আলু-সহ নানান তরকারি দিয়ে একটা পাঁচমেশালি সবজির পাশাপাশি পুঁই দিয়ে কুমড়ো থাকে। এছাড়া বেবি কর্ন, সবজি, বড়া দিয়ে তেঁতুল পোস্ত, তেল পটল, সরষে পটল, বেগুন ভাপা, মশলা ভেন্ডি, পনির পোস্ত, মশলা পনির, মোচার ঘন্ট, ধোকার সবজি, ঝিঙে পোস্ত, পাঁপড়ের তরকারি-সহ প্রায় চার-পাঁচ রকমের চাটনি।টমেটো, আনারস, আমড়া আপেল দিয়ে তৈরি চাটনি নিবেদন করা হয়। মিষ্টির পদও রকমারি। দুপুরের এই রাজভোগে মহাপ্রভুকে মিষ্টি মুখ করাতে পাটিসাপটা, নারকেল নাড়ু, তিলের নাড়ু, মালপোয়া, রসবড়া, সিমুইয়ের পায়েস থাকে।

    ভোর সাড়ে চারটেয় মঙ্গলারতিতে পেঁড়া, খেজুর ও নানান মিষ্টান্ন দিয়ে বাল্যভোগ দেওয়া হয় মহাপ্রভুকে। সকাল সাতটা বাজতেই জলখাবারে লুচি, সবজি, ক্ষীর, মিষ্টি ফল, দুধ, ছানা। বেলা ১২টা থেকে দুপুর ১ টার মধ্যে ৫৬ পদের রাজভোগ অর্পণ করার পরেই বিকেল সাড়ে চারটের সময় বৈকালিক আরতিতেও ভোগ নিবেদন করা হয়। সন্ধ্যা আরতিতে ভোগ দেওয়া হয়। তারপর রাত আটটার সময় লুচি, সবজি, হালুয়া, মিষ্টি গজা দিয়ে রাত্রিকালীন ভোগ নিবেদন করা হয় মহাপ্রভুকে। হুড়া রথ মহোৎসব কমিটির তরফে গৌতম কুণ্ডু বলেন, “এই আটটা দিন মহাপ্রভুর মাসির বাড়ি মিলনমেলার আকার নেয়।”

    এই রথযাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন পুরুলিয়া জেলা পরিষদের সহ-সভাধিপতি সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি শনিবার উলটোরথ টানবেন। তাঁর কথায়, “রাজভোগের মহাপ্রসাদ যেন অমৃত। আটটা দিন মহাপ্রভুর মাসির বাড়িতে এক মহাকর্মকাণ্ড চলে। যা চোখে দেখার মতো।” আসলে এই হুড়ার কেশরগড় ছিল পঞ্চকোট রাজপরিবারের রাজধানী। কেশরগড় থেকে রাজধানী কাশিপুরে সরে যাওয়ার পরেই এখানকার রথযাত্রা বন্ধ হয়ে যায়। তাই মহাপ্রভুর এই রথযাত্রাকে ঘিরে এক আলাদা উন্মাদনা এই হুড়ায়। একেবারে ভোর থেকেই জগন্নাথের সেবায় হেঁশেলের দরজা খুলে যায়। রান্নাবান্না চলে রাত পর্যন্ত।
  • Link to this news (প্রতিদিন)