তাঁদের প্রেমের সম্পর্ক ২০১৮ সাল থেকে। সেই সম্পর্কের কথা নিজের সমাজমাধ্যমে গোপন রাখেননি তিনি। প্রেমিকের সঙ্গে ভূরি ভূরি ছবি দিয়ে ভরিয়ে রেখেছিলেন নিজের প্রোফাইল। সে সব ছবির নীচে কেউ আশীর্বাদ করতেন, কেউ শুভেচ্ছা জানাতেন। কিন্তু গত ২৭ জুন থেকে পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে। কটূক্তি, কুৎসিত মন্তব্য এবং হেনস্থার জেরে নিজের প্রোফাইল ‘লক’ করতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
তিনি কসবার সাউথ ক্যালকাটা ল’ কলেজে ধর্ষণের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত ‘এম’-এর বান্ধবী। ওই ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ— কোনও ভাবেই যোগ নেই তাঁর। ঘটনাচক্রে, তিনি সম্পর্কে রয়েছেন (বা ছিলেন) ওই ঘটনার মূল অভিযুক্তের সঙ্গে। তাই তাঁরও ছাড় নেই!
গত ২৬ জুন ‘এম’-কে গ্রেফতার করেছিল কলকাতা পুলিশ। তার পর দিন থেকেই তাঁর সঙ্গে তাঁর প্রেমিকার ছবির কমেন্ট বক্স ভরে গিয়েছে উগ্র বিদ্বেষে। চেনা-অচেনা বহু মানুষ সে সব ছবি খুঁজে বার করছেন, তার নীচে গিয়ে ইচ্ছামতো মন্তব্য করছেন, উগরে দিচ্ছেন ধর্ষকের বিরুদ্ধে ক্ষোভ। শুধু ‘এম’ নয়, তাঁর বান্ধবীকেও নিশানা করছেন অনেকে। তরুণীর নাম এবং ছবি প্রকাশ করে চলছে উন্মত্ত হেনস্থা। সমাজমাধ্যমের এই নির্মম এবং নির্বিচার ‘ভার্চুয়াল’ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে সেই তরুণীর মনে। কিন্তু তিনি করবেনই বা কী! শুক্রবার আনন্দবাজার ডট কম-কে অসহায় তিনি বলেছেন, ‘‘আর সহ্য করতে পারছি না।’’
অভিযুক্ত ‘এম’-এর সঙ্গে সমাজমাধ্যমে তাঁর ছবি ঘোরাফেরা করতে থাকায় এলাকার লোকজন, আত্মীয়-পরিজনের কাছে হেয় হওয়া তো বটেই, সম্পূর্ণ অপরিচিত লোকজনের কাছেও তাঁকে ‘চিহ্নিত’ হতে হচ্ছে। তরুণীর প্রশ্ন, এই ব্যবহার কি তাঁর পাওয়া উচিত? এর বিহিত কে করবে? আইন? না সমাজ?
‘এম’-এর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি তরুণী। তাঁর শুধু প্রশ্ন, যে ঘটনার সঙ্গে দূরদূরান্ত পর্যন্তও তাঁর কোনও যোগ নেই, সেই ঘটনার জন্য কেন তাঁকে গালিগালাজ করা হচ্ছে? তাঁর ছবি অনুমতি ছাড়া কেন ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে? কেন তাঁর ব্যক্তিগত পরিসরকে সম্মান করা হচ্ছে না? শুধুমাত্র অভিযুক্তের সঙ্গে সম্পর্কে থাকার কারণে সমাজমাধ্যমের কাছে এই ব্যবহার কি তাঁর প্রাপ্য? তিনি বলছেন, ‘‘এই ট্রমা আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আমার পক্ষে এটা কঠিন হয়ে পড়ছে। গত কয়েক দিন ধরে আমাকে কী কী সহ্য করতে হচ্ছে, বুঝতেই পারছেন।’’
নিজেকে গোটা ঘটনার ‘ভুক্তভোগী’ বলে মনে করছেন তরুণী। তাঁর কথায়, ‘‘যে ভাবে সমাজমাধ্যমে সরাসরি আমার ছবি পোস্ট করা হচ্ছে, নোংরা কমেন্ট করা হচ্ছে, সকলে তা দেখছেন। কেউ এর প্রতিবাদ করছেন না! এটা অদ্ভুত ব্যাপার।’’
আলিপুর আদালতে আইনজীবী হিসাবে কাজ (পরিভাষায় ‘প্র্যাকটিস’) করতেন অধুনা পুলিশি হেফাজতে বন্দি ‘এম’। কসবার ঘটনার পরে রাজ্য বার কাউন্সিল তাঁর ‘এনরোলমেন্ট’ বাতিল করে দিয়েছে। তাঁর বান্ধবীও পেশায় আইনজীবী। ঘটনাচক্রে, তিনিও সাউথ ক্যালকাটা ল’ কলেজেরই প্রাক্তনী। কসবার ঘটনার পরে যে ভাবে তাঁর নাম-পরিচয়-ছবি সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তা তাঁর পেশাগত জীবনেও প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা ওই তরুণীর। ধর্ষণের ঘটনায় প্রেমিকের নাম জড়ানো নিয়ে প্রথম থেকেই অস্বস্তি ছিল, বিস্ময়ও ছিল। কিন্তু সমাজমাধ্যমে যে তাঁকে নিয়ে এমন কাটাছেঁড়া করা হবে, তা তিনি কল্পনা করতে পারেননি। ‘এম’ গ্রেফতার হওয়ার পর তাঁর প্রোফাইল থেকে নিজের নাম সরিয়ে নিয়েছিলেন তরুণী। কিন্তু তত ক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছে। অনেকেই তাঁদের ছবি পেয়ে গিয়েছেন। দেরি না করে, তরুণীর সামাজিক অসম্মানের তোয়াক্কা না-করে তা ছড়িয়েও দিয়েছেন।
সাউথ ক্যালকাটা ল’ কলেজের ভিতরে এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ মূলত এক জনের বিরুদ্ধেই। বাকি দু’জন ‘জে’ এবং ‘পি’ ওই কাজে তাঁকে সাহায্য করেছেন বলে অভিযোগ। গ্রেফতার করা হয়েছে কলেজের নিরাপত্তারক্ষীকেও। নির্যাতিতার বয়ান অনুযায়ী, গত ২৫ জুন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে রাত ১০টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত তাঁর উপর অত্যাচার চলে। প্রথমে কলেজের ইউনিয়ন রুমে তাঁকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। পরে রক্ষীর ঘরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়। ধস্তাধস্তিতে ‘প্যানিক অ্যাটাক’ হয়েছিল নির্যাতিতার। অভিযুক্তেরা তাঁকে ‘ইনহেলার’ কিনে এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু নির্যাতন থামাননি। এমনকি, তাঁকে হকি স্টিক দিয়ে মারধরের চেষ্টাও করা হয়েছে বলে নির্যাতিতার অভিযোগ। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ এই ঘটনার তদন্ত করছে। অভিযুক্তেরা সকলেই শাসক তৃণমূলের সঙ্গে যুক্ত বলে দাবি। পুলিশ কলেজ ক্যাম্পাস থেকে সংগ্রহ করেছে সাত ঘণ্টার সিসিটিভি ফুটেজ। অভিযুক্তদের ঘটনাস্থলে নিয়ে গিয়ে ঘটনার পুনর্নির্মাণও করা হয়েছে।
তদন্ত তদন্তের পথে চলবে। ধর্ষণ প্রমাণিত হলে ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন সকলেই। কিন্তু যাঁর সঙ্গে মূল ঘটনার কোনও যোগ নেই, সমাজমাধ্যমে তাঁকে অবাধে হেনস্থা নিয়ে কারও কোনও হেলদোল নেই দেখে খানিকটা হতাশই হচ্ছেন ওই তরুণী। অভিযুক্তের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কারণে তাঁকেও কেন এই সামাজিক হেনস্থার শিকার হতে হবে, বুঝতে পারছেন না তিনি। বুঝতে পারছেন না, এক নারীর জন্য বিচার চাইতে গিয়ে অন্য এক নারীকে কেন সর্বসমক্ষে হেনস্থা করা শুরু হয়েছে।