সুকান্ত মাহাত, পুরুলিয়া: বান্দোয়ান থানা থেকে গালুডি। ঘন জঙ্গলের ভিতর ঝকঝকে রাস্তা। ১০ কিলোমিটার গেলেই কুচিয়া গ্রাম। সেখান থেকে ডানদিকে আরও প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে ভোমরাগোড়া। গ্রামের মাঝখানে ডানদিকে একটা ছোট্ট দোতালা ভাঙা বাড়ি। প্রায় পরিত্যক্ত, তালাবন্দি। পাশ দিয়ে গিয়েছে কংক্রিটের ঢালাই রাস্তা।তাতে বাড়ির দরজা বেশখানিকটা নীচে দেখায়। বাড়িটা রবীন্দ্রনাথ করের। নীরবে বহন করে চলেছে জঙ্গলমহলে মাওবাদী ত্রাসের এক অভিশপ্ত অধ্যায়কে। মমতার শাসনে অনেক বদলেছে বন্দোয়ান। উন্নয়ন আর শান্তির সহাবস্থান। নির্ঘুম রাত্রি-যাপন নেই গ্রামবাসীর। কিন্তু, বাড়িটা আজও ত্রাস-রাজত্বের টাটকা সাক্ষী!
সেই রাজত্বের এক অন্যতম ট্র্যাজিক চরিত্র রবীন্দ্রনাথ কর। তখন ভরা বাম শাসন। রবীন্দ্রনাথবাবু ছিলেন দাপুটে সিপিএম নেতা। পুরুলিয়া জেলা সভাধিপতি। ২০০৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর। ভয়ঙ্কর একটা দিন। প্রায় ৪০ জন সশস্ত্র মাওবাদীর দল হানা দেয় ওই বাড়িতে। চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়। দোতালার একপাশে ছিলেন নিরাপত্তারক্ষীরা। কিছু একটা অঘটন ঘটতে যাচ্ছে আঁচ করেই স্ত্রী আনন্দময়ীকে নিয়ে বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে লুকিয়ে পড়েন। শেষরক্ষা হয়নি। মাওবাদীদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিলেন দু’জনেই। শেষে বাড়িটাও মাইন বিস্ফোরণে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। সেই স্মৃতি খুঁড়তে গেলে আজও আঁতকে ওঠেন রবীন্দ্রনাথবাবুর একমাত্র ছেলে প্রবীর কর থেকে শুরু করে বহু প্রবীণ গ্রামবাসী। রবীন্দ্রনাথবাবুর এক ছেলে ও এক মেয়ে। প্রবীরবাবু কুচিয়া হাইস্কুলের করণিক। স্কুলের অনতিদূরে বাড়ি করেছেন। পরিবার নিয়ে থাকেন। কালেভদ্রে আসেন বাপের ভিটেতে। ফিরে যান ভারাক্রান্ত হৃদয়ে। মেয়ে পুলিসের চাকরি করেন। তিনিও মাঝে মধ্যে ভোমরাগোড়াতে আসেন। বাপের বাড়ির দরজা খোলেন। খানিক থেকে চলে যান। শুক্রবার পড়ন্ত বিকেলে কুচিয়ায় বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল প্রবীরবাবুর সঙ্গে। বলছিলেন, ‘ঘটনার দিন রাতে আমি পুরুলিয়ায় ছিলাম বলে আপনার সঙ্গে আজ কথা বলছি। ৩১ ডিসেম্বর আমার জীবনের অভিশপ্ত একটা দিন। আজও মনে পড়লে কেঁপে উঠি। পোষ্টমর্টেম রির্পোট থেকে জানতে পেরেছিলাম মায়ের শরীরে ৩৬টা গুলি করেছিল মাওবাদীরা। বাবাকে বাঁচাতে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছিল মা।’ একটু থমকে ফের শুরু করলেন—‘রাতে মাওবাদীদের আসার বিষয়টি জানতে পেরেই কোঠাঘরে লুকিয়ে পড়ে বাবা-মা। একঘণ্টারও বেশি সময়ওরা খোঁজাখুঁজি করে। না পেয়ে ফিরেও যাচ্ছিল। আর তখনই নিরাপত্তারক্ষীরা শূন্যে গুলি করে বসেন। ফিরে আসে মাওবাদীরা তাণ্ডব চালায়। পুলিস একটু সচেতন হলেই বাবা-মা’কে মরতে হতো না। আতঙ্কের ওই সময়টা আর মনে করতে চাইনা। এখন গ্রামের পরিস্থিতি আলাদা। উন্নয়ন হয়েছে। শান্তিও ফিরেছে।’
পালাবদলের পর সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে ভোমরাগোড়া। গ্রামের ভিতর কোথাও পিচ রাস্তা। কোথাও ঢালাই। একাধিক জায়গায় সোলার পাম্প। রাতে রাস্তায় আলোজ্বলে কোথাও কোথাও। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে খানিক পিছিয়ে থাকলেও তা নিয়ে আক্ষেপ নেই গ্রামবাসীদের। এখন শান্তিতে বাস করছেন, সেটাই সবার বড় পাওয়া। রবিবাবুর বাড়ির ঠিক উল্টোদিকেই মুদির দোকানকান্তি করের। মাঝবয়সী বধূ। বলছিলেন,‘রবিবাবু সম্পর্কে আমার জ্যাঠাশ্বশুর। ঘটনার দিন বাড়িতেই ছিলাম। জানালা দিয়েই ওই নৃশংস ঘটনা দেখেছি। সেই আতঙ্ক ভোলার নয়। এখন অবশ্য ভয়ডর নেই। শান্তিতে রয়েছি।’সিপিএম কর্মী বৃদ্ধ লক্ষ্মণ মাহাতর গলাতেও একই সুর। তাঁর কথায়, ‘গ্রামে রাস্তা-জলের কী কাজ হয়েছে,কী বাকি রয়েছে তারচেয়েও অনেক বড় বিষয় আমরা শান্তিতে রয়েছি। ২০০৮ সালেওগণপতি ভদ্র নামে আর এক সিপিএম নেতা খুন হন। প্রকাশ্যে তাঁকে গুলি করে মাওবাদীরা। এখন সেসব অতীত।’