থানাকে না জানিয়েই অভিযান এসটিএফের, সিনেমার কায়দায় নার্সিংহোমে হানা
বর্তমান | ০৯ জুলাই ২০২৫
সুখেন্দু পাল, বর্ধমান: চিত্রনাট্য লেখা হয়েছিল আগেই। একেবারে নিখুঁত চিত্রনাট্য। আসলে, বেশ কয়েকবার রেকির পর ঠান্ডা মাথায় তৈরি হয়েছিল গোটা পরিকল্পনাটির। আর তাতেই সাফল্য। জালে উঠল বর্ধমানে ঘাপটি মেরে দেশ-বিরোধী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া দুই পাক-চর। পুলিস তো দূরের কথা, কাকপক্ষীও টের পেল না বেঙ্গল এসটিএফের এই রোমহর্ষক অভিযানের। যা কি না হার মানাতে পারে সেলুলয়েডের কোনও থ্রিলার’কেও!
সোমবারের বৃষ্টির রাত। ঘড়িতে তখন সাড়ে দশটা বেজে পঁয়তাল্লিশ কিংবা এগারোটা। নিঝুম চারিদিক। বর্ধমান থানার সামনে ইতিউতি দু’একজন লোকের ঘোরাফেরা। অনতি দূরেই একটা নার্সিংহোম। সেখানেও রোগীর বাড়ির দু’একজন লোকের আনাগোনা। বৃষ্টি ধোয়া স্ট্রিট লাইটের আবছা আলোয় থামল একটা গাড়ি, নার্সিংহোম থেকে সামান্য দূরে। গাড়ি থেকে নামলেন চারজন। সাদামাটা পোশাক সবার। গট গট করে হাঁটতে শুরু করলেন। গন্তব্য নার্সিংহোম। ঢুকতে যেতেই পথ আটকালেন নিরাপত্তারক্ষী—এমন সময় আপনারা কারা? জবাব দিলেন না কেউই। শুধুমাত্র চারজনের একজন একটু আলাদা হয়ে নার্সিংহোমের আর এক কর্মীকে কি যেন বললেন। দেখালেন সচিত্র পরিচয়পত্রও।
থ্রিলারের সবে শুরু। পরিচয়পত্র দেখে তো চোখ ছানাবড়া হয়ে যাওয়ার জোগাড় ওই কর্মীর। কাঁপা গলায় বললেন, ‘ওঁদের ছেড়ে দাও’। চারজন কারও কাছে কিছু জানতে না চেয়ে সোজা পৌঁছে গেলেন নার্সিংহোমের একটি ওয়ার্ডে। অব্যর্থ নিশানা। নির্দিষ্ট একটি বেডে ছিলেন এক যুবক। তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই কঠিন গলায় নির্দেশ—‘আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।’ যুবককে নিয়ে সোজা গাড়িতে। গাড়ি ছুটল কলকাতার উদ্দেশ্যে। নার্সিংহোমের কর্মীরা ঠায় দাঁড়িয়ে দেখলেন এই দৃশ্য। সবার চোখে অগাধ বিস্ময়। কে ছিল ওই যুবক? কি-ই বা তার পরিচয়? একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে। কারও মুখে কোনও জবাব নেই।
সিক্রেট অপারেশন সফল। জানতেও পারল না বর্ধমান থানা। অপারেশন শেষে অভিযানের প্রথা মেনে জেলা পুলিসের এক আধিকারিককে ‘ইনপুট’ শেয়ার করল বেঙ্গল এসটিএফ। মঙ্গলবার সকালে সামনে আসে নার্সিংহোমে পাকড়াও হওয়া ওই যুবক আসলে পাকিস্তানের চর। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, তার নাম রাকেশ গুপ্তা। হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল সে। ওই নার্সিংহোমে ভর্তি ছিল। গোয়েন্দারা তার টাওয়ার লোকেশন ধরে নার্সিংহোমে হানা দেন। ওই একই সময়ে মুকেশ রজক নামে আরও এক পাক চরকে মেমারি থেকে পাকড়াও করা হয়। দু’জনের কেউই পূর্ব বর্ধমানের বাসিন্দা নয়। একজনের কলকাতায়। অন্যজন কাঁকসার বাসিন্দা। কিন্তু কীভাবে রাকেশ-মুকেশ ভারতের চিরশত্রু দেশের চর হয়ে উঠল? গোয়েন্দারা তদন্তে জেনেছেন, কিছুদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে দু’জনের সঙ্গে পরিচয় পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের এক কর্মীর। তিনি নিজেকে এনজিও কর্মী পরিচয়ে মুকেশ এবং রাকেশের সঙ্গে ভাব জমান। বেশ কিছুদিন কথা বলার পর দু’জনকে কাজে লাগাতে শুরু করে। তাদের ভারতীয় মোবাইল নম্বর পাঠাতে বলা হয়। সেইমতো সিমকার্ড কিনে নম্বর পাঠাতে থাকে পাক গুপ্তচর সংস্থার কাছে। আইএসআইয়ের এজেন্ট হোয়াটসঅ্যাপ খোলার জন্য সেই নম্বর গুলি ব্যবহার করতেন। রাকেশ-মুকেশ তাঁদের ওটিপি শেয়ার করত। সিমকার্ডগুলি থাকত তাদের কাছে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, ভারতীয় নম্বরে হোয়াটসঅ্যাপ খুলে আইএসআইয়ের লাভ কি? এক গোয়েন্দাকর্তা বলছিলেন, মূলত হানিট্র্যাপের জন্য নম্বরগুলি ব্যবহার করা হতো। ভারতীয় নম্বর থেকে পাক গুপ্তচর সংস্থা বিভিন্ন বাহিনীর আধিকারিকদের কাছে মেসেজ পাঠানোর পরিকল্পনা করেছিল। সেইসব প্রোফাইলে মহিলার ছবি থাকত। অনেক ক্ষেত্রে মহিলাদের দিয়ে তারা সরাসরি আধিকারিকদের ফোন করিয়ে গোপন তথ্য হাতিয়ে নিত। স্রেফ ওটিপি এবং নম্বর পাঠিয়ে মোটা টাকা পেত রাকেশ-মুকেশ। অনলাইনে সেই টাকা আসত বলে জানা গিয়েছে। দু’জনেই বর্ধমান, মেমারি সহ বিভিন্ন জায়গা ঘুরে সিমকার্ড কিনত। ক’দিন তারা মেমারিতে আশ্রয় নিয়েছিল। সাধারণের সঙ্গে মিশেই তারা অপারেশন চালাত।