• বদলানো সময়-জমিতে প্রমথেশেরা শুধুই অতীত
    আনন্দবাজার | ০৯ জুলাই ২০২৫
  • কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে সকালে প্রয়াত হলেন বহরমপুরের প্রাক্তন সাংসদ প্রমথেশ মুখোপাধ্যায়। সেই দিন বিকালেই বহরমপুরে জেলা কমিটির বৈঠক থেকে দলের নতুন জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব পেলেন ছাত্র সংগঠনের নেতা নওফেল মহম্মদ সফিউল্লা (অ্যালবার্ট)। প্রতীকী হয়ে উঠতেই পারতো। কিন্তু সোমবারের দুই ঘটনা নিছক সমাপতন হয়ে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি!

    কারণ, সে মুর্শিদাবাদ আর নেই! সে আরএসপি নেই। সেই বামফ্রন্টও নেই! কংগ্রেসের ‘গড়ে’ প্রতাপশালী শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। বিভাজনের হাওয়ায় পাল তুলে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উঠে আসছে বিজেপি। আরএসপি এবং সামগ্রিক ভাবে বামেরা এখন নবাব-ভূমে অনেকটাই প্রান্তিক শক্তি। এক সময়ে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের মতো রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং জাঁদরেল কংগ্রেস নেতাকে হারিয়ে সাংসদ হওয়া প্রমথেশের মৃত্যু, তাঁর স্মরণে দল নির্বিশেষে রাজ্য রাজনীতির কুশীলবদের শ্রদ্ধাবনত হওয়া এবং প্রমথেশের জেলায় একেবারে তরুণ এক নেতার দলে দায়িত্ব পাওয়া— এ সব তার প্রত্যাশিত তাৎপর্য বয়ে আনতে পারছে না।

    অথচ ইতিহাস ঘাঁটলে উঠে আসবে, মধ্যবঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভূখণ্ড মুর্শিদাবাদ যতটা কংগ্রেসের ‘গড়’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে, আরএসপি-র ভিত সেখানে কোনও অংশেই নরম ছিল না! স্বাধীনতার পর থেকে ত্রিদিব চৌধুরীর মতো নেতা দেখেছে মুর্শিদাবাদ। বহরমপুর থেকে আরএসপি-র প্রতীকে ৭ বার লোকসভায় গিয়েছেন ‘ঢাকুদা’। তাঁর জায়গায় ওই আসনে এসেছেন ননী ভট্টাচার্য, তাঁর প্রয়াণে প্রমথেশ। বাম জমানায় রাজ্যে মন্ত্রিত্ব করার পাশাপাশি পরে দলের দায়িত্ব সামলেছেন দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। এঁরা সকলে যদি বর্ণ হিন্দুর প্রতিনিধি হয়ে থাকেন, এই জেলা থেকে আরএসপি-র নির্বাচিত বিধায়কদের তালিকায় জানে আলম মিঁয়া, ইদ মহম্মদের মতো নাম কম নেই। মানুষের দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজনীতিই সে কালে ছিল মুখ্য, ধর্মীয় পরিচয় নয়। সেই আরএসপি-র এখন গোটা জেলায় বিধায়ক তো নেই-ই, রাজনৈতিক প্রভাবও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর।

    কী ভাবে হল এই পট পরিবর্তন? প্রবীণ বাম নেতারা মনে করেন, আরএসপি-সহ বামপন্থী দলগুলির মূল ভিত ছিল কৃষক। কৃষি আন্দোলনই জেলায় তাদের জমি তৈরি করে দিয়েছিল। বাম রাজনীতির হাত ধরে এক কালের ভূমিহীনেরা পরে জমির মালিক হয়েছেন, কৃষকদের উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যবসা-সহ অনান্য পেশায় ছড়িয়ে গিয়েছেন। জমির মালিক, তুলনায় আর্থিক ভাবে একটু উন্নত মানুষের কাছে বাম রাজনীতির আবেদন কমতে শুরু করেছে। কালক্রমে মুর্শিদাবাদের বড় অংশের মানুষ পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দিয়েছেন। আদর্শভিত্তিক রাজনীতি আঁকড়ে থাকার চেয়ে ‘ব্যক্তিগত স্বার্থ’ এবং কিছু ক্ষেত্রে ‘নিরাপত্তা’র খাতিরে নির্দিষ্ট ছকে ভোট দেওয়াই তাঁদের কাছে সুবিধাজনক মনে হয়েছে।

    আরএসপি-র সাধারণ সম্পাদক মনোজ ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি বিপুল ভাবে পাল্টে গিয়েছে। এখনকার কৃষি ক্ষেত্রের সঙ্গে মানানসই কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলা যায়নি। বামপন্থী আন্দোলন এক দিকে দুর্বল হয়েছে। তেমনই মুর্শিদাবাদ ঘুরে দেখলে বোঝা যাবে, মসজিদের সংখ্যা কত বেড়ে গিয়েছে। জনসংখ্যার অনুপাত কিন্তু সে ভাবে বদলায়নি। মসজিদের বিপরীতে আবার মন্দির তৈরির প্রবণতাও বেড়েছে। রাজনীতির অভিমুখটাই বলদে গিয়েছে।’’ বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান, বর্ষীয়ান নেতা বিমান বসুর মতে, মুর্শিদাবাদের মতো জেলায় তৃণমূল যে ভাবে বিরোধীদের হাতে থাকা নির্বাচিত পঞ্চায়েত, পুরসভার দখল নিয়েছে, অতীতে কেউ কখনও তা করেনি। স্থানীয় প্রশাসনে কাজ করে মানুষের সামনে ‘বিকল্প’ দেওয়ার যে সুযোগ বিরোধীদের জন্য ছিল, এখন আর নেই। এই শূন্যতার সুযোগে ধর্মের রাজনীতি নিয়ে উঠে এসেছে বিজেপি। যাকে আবার মদত দিয়ে চলেছে তৃণমূলেরই কাজকর্ম।

    রাজনৈতিক পরিসরে কোণঠাসা হতে হতে সংগঠনও রক্তশূন্য হয়ে পড়েছে আরএসপি-র মতো বাম শরিক দলের। মুর্শিদাবাদ বলেই সফিউল্লার মতো তরুণ মুখ এখনও পেয়েছে ত্রিদিব-ননী-দেবব্রতদের দল। অন্যত্র দলে নতুন প্রজন্মের অন্তর্ভুক্তিই কার্যত রুদ্ধ। এমতাবস্থায় প্রমথেশেরা শুধুই অতীত হচ্ছেন। নির্বাচনে একাধিক পরাজয়ের মুখেও সদ্যপ্রয়াত প্রাক্তন সাংসদ বলতেন, হার-জিত রাস্তার ধুলোর মতো। গা থেকে ধুয়ে ফেলতে হয়। রাজনৈতিক আদর্শটাই আসল।

    সে কথা বলা এবং মানার লোক আর কোথায়!
  • Link to this news (আনন্দবাজার)