বিজেপির নীচের স্তরেও কি বদল আসন্ন? ‘স্থিতাবস্থা আশ্বাস’ ছিল সুকান্তের বয়ানে, শমীকের মুখে ‘সংশোধনের সুর’, জল্পনা শুরু
আনন্দবাজার | ০৯ জুলাই ২০২৫
ঠিক এক সপ্তাহ আগে দিল্লি থেকে জগৎপ্রকাশ নড্ডার ফোন এসেছিল তাঁর কাছে। বিজেপির রাজ্য সভাপতি নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে। তার পর থেকে এ পর্যন্ত ঝড়ের মতো সময় কেটেছে শমীক ভট্টাচার্যের। মোটের উপর ‘মধুচন্দ্রিমা পর্ব’ই বলা যায়। কিন্তু এ বার ‘কঠিন’ সময় শুরু। সুকান্ত মজুমদারের সভাপতিত্বে হওয়া ‘সংগঠন পর্বে’ মণ্ডল বা জেলার দায়িত্ব যাঁদের হাতে গিয়েছিল, সর্বত্র তাঁদের নিয়েই কি কাজ করবেন শমীক? না কি ‘প্রয়োজন অনুযায়ী’ কোথাও কোথাও মুখ বদলে দেওয়ার মতো ‘কঠিন’ সিদ্ধান্তও নেবেন? বিজেপির অন্দরে এ বার জল্পনা শুরু হয়েছে তা নিয়ে। ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে শমীক বলছেন, ‘‘সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন বিজেপি-তে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।’’
গত ২ জুলাই দুপুরে বিধাননগরে বিজেপির রাজ্য কার্যালয়ে গিয়ে সভাপতি নির্বাচনে মনোনয়নপত্র পেশ করেন শমীক। পরের দিন যে শমীকের নামই সভাপতি হিসেবে আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষিত হবে, তা-ও সে দিনই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। ফলে সেই বুধসন্ধ্যায় বিদায়ী সভাপতি হিসেবে শেষ সাংবাদিক বৈঠকটি করে রাজ্য দফতর থেকে বেরিয়েছিলেন সুকান্ত। আর সুকান্তের সেই আলাপচারিতাতেই নিহিত ছিল রাজ্য বিজেপির অন্দরে এই মুহূর্তে চলতে থাকা জল্পনার বীজ। সুকান্ত সে দিন একাধিক বার বলেছিলেন, ‘‘বিজেপিতে নেতৃত্বের পরিবর্তন একটা স্বাভাবিক এবং বহমান প্রক্রিয়া। নির্দিষ্ট সময় অন্তর ব্যাটন হস্তান্তর হয়ে থাকে।’’ তবে ‘ব্যাটন হস্তান্তর’ হলেই যে পুরনো সব কিছু বদলে যাবে, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই বলেই সুকান্ত মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘সংগঠন পর্বের মধ্য দিয়ে বুথ, মণ্ডল, জেলা স্তরে আমি যাঁদের দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছি, তাঁদের নিয়েই শমীকদা চলবেন। সভাপতি বদল হল বলে সব স্তরে সব কিছু বদলে যাবে, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই।’’
দায়িত্ব নেওয়ার পরে শমীকও বলেননি যে, সুকান্তের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন স্তরে যাঁরা গত কয়েক মাসে দায়িত্ব পেয়েছেন, তাঁদের সকলকেই তিনি সরিয়ে দেবেন। তবে সকলকেই আপাতত দায়িত্বে রেখে দেওয়া হবে, তেমন কোনও নিশ্চয়তাও নেই বলে শমীক স্পষ্ট করেছেন। আনন্দবাজার ডট কমকে শমীক বলেন, ‘‘সুকান্ত মজুমদার ঠিকই বলেছেন। সংগঠন একটা বহমান বিষয়। সুতরাং প্রয়োজন না পড়লে কাউকে সরানো হবে না। কিন্তু প্রয়োজন পড়লে বিজেপিতে সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন ঘটেই থাকে। পুরোটাই প্রয়োজনীয়তার উপরে নির্ভর করছে।’’
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির মণ্ডল কমিটির সংখ্যা ১৩০০-রও বেশি। সাংগঠনিক জেলা ৪৩টি। প্রায় সব মণ্ডলেই নতুন সভাপতি নির্বাচিত হয়ে গিয়েছেন। সিংহভাগ মণ্ডলে কমিটি গঠনও সম্পন্ন। ৩৯টি জেলা কমিটিও পরবর্তী মেয়াদের সভাপতি পেয়ে গিয়েছে। বাকি শুধু চার জেলার সভাপতি বাছাই— বনগাঁ, ব্যারাকপুর, ঘাটাল এবং দার্জিলিং। রাজ্য বিজেপির একাংশের দাবি, শমীকের তত্ত্বাবধানে শুধু এই চারটি জেলাতেই সভাপতি বাছাই হবে। আর কোথাও কোনও বদল হবে না। কিন্তু দলের অন্য একটি সূত্র বলছে, আরও কয়েকটি জেলায় সভাপতি বদল হতে পারে। তার দু’টি কারণ আছে বলে সেই সূত্রের দাবি। প্রথমত, বেশ কয়েকটি জেলায় সভাপতি বাছাই ঘিরে অভ্যন্তরীণ বিবাদ তুঙ্গে পৌঁছেছিল। সেই কোন্দল দলের অন্দরে সীমাবদ্ধ থাকেনি। প্রকাশ্যেও চলে এসেছিল। ক্ষোভের আঁচ সে সব এলাকায় এখনও বহাল। দ্বিতীয়ত, এ বারের ‘সংগঠন পর্বে’র মাধ্যমে বাছাই হওয়া সব জেলা সভাপতি আশানুরূপ কাজ করতে পারছেন না। সাংগঠনিক লক্ষ্যপূরণে ইতিমধ্যেই কারও কারও ব্যর্থতা নজরে পড়তে শুরু করেছে।
বুথ সশক্তিকরণ কর্মসূচির আওতায় গোটা রাজ্যেই বিজেপি এই মুহূর্তে নিজের সাংগঠনিক কাঠামোর প্রকৃত চেহারা খতিয়ে দেখছে। প্রথমে প্রত্যেকটি মণ্ডলে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে জোর দেওয়া হয়েছিল। তার পরে শক্তিকেন্দ্র (পাঁচটি বুথ) এবং বুথ স্তরে গিয়েও পরিস্থিতি সরেজমিনে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এই সাংগঠনিক জরিপের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক সুনীল বনসল মাসে বার তিনেক করে বৈঠকে বসছেন। কোথায় কাজ কতটা এগিয়েছে, তার হিসাব বুঝে নিয়ে পরবর্তী ধাপের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিচ্ছেন। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে একাধিক জেলা ‘আশানুরূপ’ ফল দিতে ব্যর্থ বলে বিজেপি সূত্রের খবর। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির পাঁচটি সাংগঠনিক ‘জ়োন’ রয়েছে। তার মধ্যে কলকাতা, নবদ্বীপ এবং হাওড়া-হুগলি-মেদিনীপুর জ়োনের অন্তর্গত বেশ কয়েকটি জেলার ফলাফল খারাপ বলে বিজেপি সূত্রের খবর। সেই সব জেলার নেতৃত্বে শমীক পরিবর্তন ঘটাতে পারেন বলেও বিজেপির একাধিক সূত্রের দাবি।
তবে শুধু জেলা স্তর নয়, পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সবচেয়ে পুরনো মুখগুলির অন্যতম হওয়ায় শমীক রাজ্যের বহু এলাকায় মণ্ডল বা বুথ স্তরের কর্মীদেরও নামে চেনেন। ওই সব স্তরের অনেক কর্মীর সঙ্গে তাঁর সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। ফলে মণ্ডল বা বুথ স্তরে খবর পেতে তিনি সব সময় জেলা নেতৃত্বের কাছ থেকে পাওয়া রিপোর্টের ভরসায় থাকবেন না বলেও বিজেপি-তে অনেকে মনে করছেন। তাঁদের এই ধারণায় বাড়তি অক্সিজেন জুগিয়েছে শমীকের একটি মন্তব্য। বুথে যাঁদের ‘অস্তিত্ব, ব্যক্তিত্ব, দাপট’ রয়েছে, বুথের নেতৃত্ব তাঁদের হাতেই থাকবে বলে নতুন রাজ্য সভাপতি মন্তব্য করেছেন।
নীচের তলার সাংগঠনিক দায়দায়িত্বে কি তা হলে বড় বদল আসতে চলেছে? রাজ্য বিজেপির নতুন সভাপতি কথার মারপ্যাঁচে উত্তর দিচ্ছেন। বলছেন, ‘‘বললাম তো, সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন আমাদের দলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। প্রয়োজন বুঝে সংশোধন হতেই পারে। তবে আমাদের মূল লক্ষ্য সংযোজন।’’