সৌরভ মাজি, বর্ধমান: বেনামে সিম কার্ড তুলত। তার পর সেই নম্বরে হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্ট খোলা হত পাকিস্তানে। আর হোয়াটসঅ্যাপ চালু করতে যে ওটিপি আসত তা তুলে দেওয়া হত পাকিস্তানের সংগঠনকে। আর পাকিস্তানে বসেই ভারতের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর ব্যবহার করে চরবৃত্তি ও সেনাবাহিনীর কর্তাদের হ্যানিট্র্যাপে ফেলে গোপন তথ্য হাতানোর চেষ্টা করত আইএসআই। তাদের হয়েই কি না গুপ্তচরের কাজে মদত দিচ্ছিল দুই যুবক। রাজ্যের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স বা এসটিএফ শনিবার রাতে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করেছে মুকেশ রজক ও রাকেশ কুমার নামে দুই সন্দেহভাজনকে। তারাই কিনা মেমারির পাওয়ার হাউস সংলগ্ন এলাকায় দিঘির পাড়ে অভিজাত আবাসনে ভাড়া নিয়ে ডেরা বেঁধেছিল, বিশ্বাসই করতে পারছেন না এলাকার বাসিন্দারা। পাক জঙ্গি যোগ থাকতে পারে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। ২০১৪ সালের বর্ধমানের খাগড়াগড় কাণ্ডের ১১ বছরের মাথায় ফের জঙ্গি যোগের ঘটনা সামনে এল।
এসটিএফ সূত্রে খবর, পহেলগাঁওয়ে হামলা পর ভারতীয় সেনাবাহিনী অপারেশন সিঁদুর শুরু করেছিল। সেই সময় থেকেই রাকেশ ও মুকেশরা গুপ্তচরবৃত্তিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে বলে জানা গিয়েছে। তখন থেকেই নজরদারি চালানো হচ্ছিল। শনিবার গভীর রাতে মেমারির ঈপ্সিতা অ্যাপার্টমেন্ট থেকে রাকেশকে গ্রেপ্তার করে এসটিএফ। তার পর বর্ধমানের একটি নার্সিংহোমে ভর্তি থাকা মুকেশকে ধরে। সোমবার তাদের কলকাতার আদালতে পেশ করে সাতদিনের হেফাজতে নিয়েছে এসটিএফ। এই ঘটনাকে অনেকেই ২০১৪ সালে বর্ধমানের খাগড়াগড় কাণ্ডের সঙ্গে তুলনা করছেন। মেমারির ওই এলাকার বাসিন্দারা বিশ্বাসই করতে পারছেন না, পাক গুপ্তচর বাড়ির পাশে ডেরা বেঁধেছিল।
২০১৪ সালে খাগড়াগড়ে বাড়ি ভাড়া নিয়ে ডেরা বেঁধেছিল জামাতউল মুজাহিদিন বাংলাদেশ বা জেএমবি জঙ্গিরা। সেখানে ভাড়া বাড়িতে গড়ে তুলেছিল আইইডি বিস্ফোরক তৈরির কারখানা। ওই বছর ২ অক্টোবর জঙ্গি ডেরায় বিস্ফোরণ ঘটেছিল। তারপরই প্রকাশ্যে এসেছিল জঙ্গিদের কথা। তার আগে কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পাননি জঙ্গিদের কথা। খাগড়াগড়ে ভাড়া বাড়িতে থাকা জঙ্গিরা এলাকার মানুষজনের সঙ্গে বিশেষ মেলামেশা করত না। কেউ তাদের চিনত না। এলাকার মানুষজনের সঙ্গে কথাবার্তাও তারা বলত না। প্রায় একই কথা জানাচ্ছেন মেমারির বাসিন্দারাও। তাঁদের কথায়, “মেমারি খুবই শান্তিপূর্ণ এলাকা। সেখানে কীভাবে পাক গুপ্তচররা ঘাঁটি গেড়েছিল বুঝতে পারছি না। হয়তো শান্তিপূর্ণ এলাকা বলেই ডেরা বেঁধেছিল ওরা।”
স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, মাস ছয়েক ধরে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকলেও এলাকার মানুষজন তো বটেই পাশের ফ্ল্যাটের লোকজনের সঙ্গেও কথাবার্তা বলত না। নিজেদের মতো তারা থাকতো। এই প্রসঙ্গেই তপন বিশ্বাস নামে একজন বলেন, “খাগড়াগড়ে আমরা জেএমবি জঙ্গি ডেরার কথা শুনেছিলাম। কিন্তু মেমারিতেও যে পাক গুপ্তচর ডেরা বাঁধতে পারে কল্পনায় ছিল না। জেএমবি জঙ্গি হোক বা পাক গুপ্তচর, তারা দেশের শত্রু। অভিযোগ সঠিক হলে ওদের যেন চরম শাস্তি হয়। আরও কেউ যুক্ত থাকলে কেউ যেন ছাড় না পায়।” এসটিএফ সূত্রে খবর, ওই আবাসনের মালিক, মেমারির যে সব দোকান থেকে সিমকার্ড কেনা হয়েছিল সেই বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রয়োজনে তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে বলে জানা গিয়েছে।
বাড়ির মালিক দিলীপ সিকদার থাকেন মেমারির দেশবন্ধুপল্লী এলাকায়। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষক পরিচয়ে ঘর ভাড়া নিয়েছিল রাকেশ। দিলীপ বলেন, “আমি কোনও দিনই ভাড়া নিতে যেতাম না। গিটার বাজিয়ে প্রার্থনা করত বলে শুনেছি। অনলাইনে ভাড়া পেয়ে যেতাম। কিন্তু তলে তলে যে তারা এইসব কাজ করছে বুঝতে পারিনি। আমি জানতাম, মা ও ছেলে থাকে। তবে এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, ৬-৭ জন না কি থাকত। এছাড়াও আসতো অচেনা অনেকেই।” আগে কিছুই জানতে পারেননি। এসটিএফ তাদের গ্রেপ্তার করার পর এখন সব শুনছেন।