ওড়িশায় অঘোষিত ‘ডিটেনশন ক্যাম্পে’ বন্দি পরিযায়ী শ্রমিকরা, দিনভর ম্যারাথন জেরা, আটকে কালীগঞ্জের আরও ২
বর্তমান | ১১ জুলাই ২০২৫
নিজস্ব প্রতিনিধি, কৃষ্ণনগর: দেশের নাগরিক হিসেবে পাসপোর্টও যথেষ্ট নয়। অন্তত, বিজেপি শাসিত ওড়িশা রাজ্যে এই প্রমাণপত্রও হালে পানি পাচ্ছে না! বাংলাতে কথা বললেই পড়তে হচ্ছে বিপদে। পরিচয়পত্র হিসেবে বৈধ পাসপোর্ট দেখালেও পুলিসের নানা অস্বস্তিকর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে বাংলার শ্রমিকদের। দেশের মধ্যেই অন্য রাজ্যে কাজ করতে যাওয়ার জন্য কেন পাসপোর্ট বানিয়েছেন তাঁরা? সেই পাসপোর্ট ব্যবহার করে তাঁদের বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তানে যাওয়ার কোনও পরিকল্পনা রয়েছে কিনা? —এইরকম নানা প্রশ্ন করা হচ্ছে। দীর্ঘ চারদিন ধরে শ্রমিকদের কার্যত বন্দি রেখে ম্যারাথন জেরা করছে ওড়িশার পুলিস। সেইসঙ্গে করা হচ্ছে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ। শ্রমিকদের উত্তর ও বৈধ পরিচয়পত্রেও সন্তুষ্ট না হলে, জমির পুরোনো দলিল দেখতে চাওয়া হচ্ছে। তখন তাঁরা বাড়ির লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেই দলিলের ছবি জোগাড় করছেন। ওড়িশায় ঝাড়সুগুদায় বিয়েবাড়ির জন্য ভাড়া দেওয়া লজকে অঘোষিত ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ বানিয়ে বাংলাদেশি সন্দেহে বাংলার শ্রমিকদের আটক করে রাখা হচ্ছে।
কালীগঞ্জ ব্লকের পলাশি-১ পঞ্চায়েতের এরকম আরও দু’জন বন্দি পরিযায়ী শ্রমিকের হদিশ পাওয়া গিয়েছে। অর্থাৎ, সবমিলিয়ে এখনও পর্যন্ত কালীগঞ্জের ২৯ জন পরিযায়ী শ্রমিকের আটকে থাকার তথ্য পেয়েছে রাজ্য পুলিস। যদিও তাঁদের মধ্যে চারজনকে বুধবার রাতেই সেই শিবির থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, বর্তমানে কালীগঞ্জের ২৫ জন পরিযায়ী শ্রমিক বেআইনিভাবে বন্দি। ওড়িশা সরকার এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করছে না। কৃষ্ণনগর পুলিস জেলার তরফে কালীগঞ্জের পরিযায়ী শ্রমিকদের তালিকা তৈরি করে ওড়িশা পুলিসের কাছে পাঠানো হয়েছে। সেই তালিকায় পুলিসের তরফ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে, আটকে থাকা শ্রমিকরা কালীগঞ্জের বাসিন্দা।
কৃষ্ণনগর পুলিস জেলার এসপি অমরনাথ কে বলেন, আমরা স্থানীয়ভাবে কালীগঞ্জের ২৯ জন পরিযায়ী শ্রমিকের পরিচয়পত্র পেয়েছি। যাঁদেরকে ওড়িশায় আটকে রাখা হয়েছিল। শ্রমিকদের তালিকা তৈরি করে আমরা সেখানকার পুলিসকে পাঠিয়েছি। বুধবার পর্যন্ত চারজনকে ছাড়া হয়েছে।
কৃষ্ণনগর লোকসভার সাংসদ মহুয়া মৈত্র বলেন, এইভাবে কাউকে দিনের পর দিন আটকে রাখা যায় না। ওড়িশার পুলিস যেটা করছে, সেটা বেআইনি। যাঁরা ওড়িশায় আটকে রয়েছেন তাঁদের দ্রুত ফিরিয়ে আনানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আমরা উচ্চ আদালতে বিষয়টি জানিয়েছি। আদালত ওড়িশার মুখ্য সচিবের কাছে বাংলার শ্রমিকদের বন্দি করে রাখার বিষয় নিয়ে জানতে চেয়েছে।
বুধবার রাতে মুক্তি পেয়েছেন কালীগঞ্জের আসাদুল হক ও তাঁর ভাই। কিন্তু তাঁদের সঙ্গীরা এখনও বন্দি ওই শিবিরে। বৃহস্পতিবার তাঁর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, বুধবার রাত একটা নাগাদ আমাদের ছাড়া হয়েছে। আমার কাছে পাসপোর্ট ছিল। এনআরসির মতো আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে। আমি পাসপোর্ট কেন করেছি, কোথায় যাবো, সমস্ত কিছু জানতে চাইছে। আমার বাবা-মা ভারতীয় কিনা জিজ্ঞেস করছে। ১৯৭৫ সালের জমির দলিল চাইছে। বাড়ির লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেগুলো দেখালাম। আমাদের গালিগালাজও করছে। পরিচয়পত্র দেখানো সত্ত্বেও আমাদের বাংলাদেশি বলছে।
ওড়িশার ঝাড়সুগুদা জেলার ওই লজকেই কার্যত ডিটেনশন ক্যাম্প হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। রবিবার সেই জেলার অন্তর্গত বাদমাল, ওরিয়েন্ট, বাজাজনগর করিয়ান সহ পাঁচটি থানা এলাকা থেকে বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের তুলে আনা হয়। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কালীগঞ্জের পরিযায়ী শ্রমিকরাও। প্রথমে ২৩ জন শ্রমিকের পরিচয়পত্র পাওয়া গিয়েছিল। বর্তমানে তার বেড়ে হয়েছে ২৯ জন। গত কয়েকদিন ধরেই প্রায় এক হাজার পরিযায়ী শ্রমিককে সেই লজে বন্দি রেখে নাগরিকত্বের যাচাই করা হচ্ছে। সকালে চিঁড়ে আর গুঁড় দেওয়া হচ্ছে শ্রমিকদের। বাকি দু’বেলা ডাল, ভাত, আলু সেদ্ধ। সবাই সেই খাবার পাচ্ছেন না। মেঝেতেই কাপড় বিছিয়ে কোনওরকমে রাত কাটাচ্ছেন তাঁরা। তার মধ্যেই দফায় দফায়