• বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশ্ন বিভ্রাট, বিপ্লবীদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে উল্লেখ
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ১১ জুলাই ২০২৫
  • বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আজব কাণ্ড! ইতিহাসে এতদিন যাঁদেরকে বিপ্লবী হিসেবে আমরা মর্যাদার আসনে বসিয়েছিলাম, ব্রিটিশ আমলে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করা সেই বিপ্লবীরা হয়ে গেলেন সন্ত্রাসবাদী। সম্প্রতি পশ্চিম মেদিনীপুরে স্নাতক স্তরের প্রশ্নপত্রে এই কাণ্ড ঘটেছে। বিষয়টি চাউর হতেই রাজ্য জুড়ে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে। বিতর্কের মুখে পড়ে অবশেষে দুই অধ্যাপককে পদ থেকে অব্যাহতি দিলেন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

    বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করেন পরীক্ষা নিয়ামক। আবার ‘বোর্ড অফ স্টাডিজ’ নামের একটি কমিটি থাকে স্নাতক স্তরের জন্য। এই কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য এমন একজনকে চেয়ারম্যানও করা হয়। বাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা বিভিন্ন কলেজের সদস্যরা থাকেন এই কমিটিতে। সেই বোর্ড অফ স্টাডিজের চেয়ারম্যান ও আরও একজন সদস্যকে এই কমিটিতে তাঁদের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

    জানা গিয়েছে, বুধবার স্নাতক স্তরের ষষ্ঠ সেমেস্টারের ইতিহাস পরীক্ষা ছিল পশ্চিম মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে একটি প্রশ্ন ছিল— ‘মেদিনীপুরের তিনজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নাম কর, যারা সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারা নিহত হন?’ এই প্রশ্নপত্র ঘিরেই বিতর্ক দানা বাঁধে। অনেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে উল্লেখের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে ঔপনিবেশিক মানসিকতার প্রতিফলন দেখতে পেয়েছেন। আর এই বিষয়টি ছড়িয়ে পড়তেই শুরু হয় বিতর্ক।

    যদিও বুধবার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পরে অন্য কথা বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তাঁরা জানিয়েছেন, প্রশ্নপত্রের অনুবাদের ভুল হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বৃহস্পতিবার একটি সাংবাদিক বৈঠকও করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দীপককুমার কর। তিনি বলেন, ‘এর জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী। দুঃখপ্রকাশ করছি। এ সবের সঙ্গে মানুষের ভাবাবেগ জড়িত। এই ঘটনা একেবারেই বাঞ্ছনীয় নয়। ভবিষ্যতে এর যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, আমরা সেটা দেখব।’ উপাচার্য আরও বলেন, ইংরেজি শব্দের বঙ্গানুবাদে ভুল হয়েছে। তাতে শব্দ বাদ চলে গিয়েছে। সেজন্যই এই ঘটনা ঘটেছে।

    এ ব্যাপারে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান নির্মল মাহাতো জানিয়েছিলেন, ইংরেজি প্রশ্নপত্রের ‘মিলিট্যান্ট ন্যাশনালিস্ট’ শব্দটির অনুবাদে ভুল হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলা অনুবাদটি যদি ঠিকঠাক হতো, তাহলে ওই শব্দটা ‘কোট-আনকোটের’ মধ্যে থাকতো।

    বিষয়টি নিয়ে উপাচার্য বলেন, ‘ঔপনিবেশিক শব্দ যাতে পাঠ্য বইয়ে না থাকে, সেটাও দেখতে হবে। সিলেবাস তৈরির সময় আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যে ভুল হয়েছে, তা একেবারেই সাধারণ ভুল নয়। এই বিষয়টি আমরা অধিক গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।’

    উল্লেখ্য, ব্রিটিশ আমলে বরাবরই বিপ্লবীদের ঘাঁটি বলে পরিচিত ছিল মেদিনীপুর জেলা। সেখানে একাধিক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছিল, যা আমরা আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় দেড় দশক আগে পর পর তিন বছরে ব্রিটিশ সরকারের তিনজন জেলাশাসক এই জেলাতেই খুন হয়েছিলেন। এই তিন জেলাশাসক হলেন– পেডি, ডগলাস এবং বার্জ। এঁদের মধ্যে জেলাশাসক পেডি ১৯৩১ সালে, ডগলাস ১৯৩২ সালে এবং বার্জ ১৯৩৩ সালে খুন হয়েছিলেন।

    আবার পরাধীন ভারতের খবরের কাগজেও এইসব বিপ্লবীদের ‘অ্যানার্কিস্ট’ বলে উল্লেখ করা হত, যার বিরোধিতা করেছিলেন বিপ্লবী বাঘা যতীন ও যদুগোপাল মুখোপাধ্যায়। তাঁরা ‘অ্যানার্কিস্ট’ শব্দের ব্যবহার বন্ধ করার জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন। তাঁরা তৎকালীন সংবাদপত্রগুলিকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেছিলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিপ্লববাদী বা ‘রিভলিউশ্যানিস্ট’ বলে উল্লেখ করতে। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ব্যাখ্যা ছিল, ‘বাংলার তরুণ দেশের জন্য প্রাণ দেবে আর ইংরেজরা তাঁদের ডাকাতের দল বলে প্রচার করবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না।’
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)