বাংলার ২০০ পরিযায়ী শ্রমিককে আটকে ‘পুশব্যাক’-এর চক্রান্ত
দৈনিক স্টেটসম্যান | ১১ জুলাই ২০২৫
ওড়িশায় বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসতেই সেখানে বাঙালি বিদ্বেষ অব্যাহত রয়েছে। বাংলা বললেই বাংলাদেশি। এই ট্রেন্ড কোনও মতেই শেষ হচ্ছে না। সেখানে বাঙালিদের বিরুদ্ধে রীতিমতো ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উঠেছে। গত কয়েকদিন আগে রাজ্যের কয়েকজন গরিব ফেরিওয়ালাকে আটকের পর ফের একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে। সম্প্রতি ওড়িশার ঝারসুগুড়ায় বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর চড়াও হল সেখানকার প্রশাসন। কমপক্ষে ২০০ জন পরিযায়ী শ্রমিককে ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে আটক করেছে। তাঁরা সকলেই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার বাসিন্দা বলে জানা গিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের এভাবে বাংলাদেশি সন্দেহে আটক করে ‘পুশব্যাক’ করার চেষ্টা করছে। এভাবে একের পর এক বিজেপি শাসিত রাজ্যে দিনের পর দিন বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে।
ইতিমধ্যে জানা গিয়েছে, পড়শি রাজ্য ওডিশায় আটকে রয়েছেন নদিয়ার ২৩ জন পরিযায়ী শ্রমিক। কৃষ্ণনগর লোকসভার অন্তর্গত কালীগঞ্জের পানিঘাটা গ্রামপঞ্চায়েতের মির্জাপুরের বাসিন্দা তাঁরা। তাঁদের কাছে রয়েছে ভোটার ও আধার কার্ড সহ সমস্ত বৈধ কাগজপত্র। তা সত্ত্বেও তাঁদের আটকে রেখেছে ঝাড়সুগুদায় ওরিয়েন্ট থানার পুলিশ। বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছেন কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়া মৈত্র। তিনি ‘বেআইনিভাবে’ এই পরিযায়ী শ্রমিকদের আটকে রাখার অভিযোগ তুলেছেন। এক্স হ্যান্ডলে মহুয়া লেখেন, ‘নবীন পট্টনায়েক যখন ওড়িশার মসনদে ছিলেন, কোনও দিন এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। অথচ এখন প্রতিনিয়ত এমনটা ঘটছে।’
ওড়িশা সরকার অবশ্য বিষয়টি নিয়ে তাদের পক্ষে সাফাই দিয়েছে। জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এবং ওড়িশা সরকারের জারি করা নির্দেশিকা মেনে তাদের নথি যাচাই করা হচ্ছে। এঁদের মধ্যে অনেকেই জেলার বিভিন্ন অংশে শ্রমিক, রাজমিস্ত্রি, হকার এবং ঘর রং করার কাজ করতেন। রাজ্য সরকারের এই পদক্ষেপটি দেশে অবৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশী নাগরিকদের সনাক্ত করার জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশে শুরু হওয়া বৃহত্তর অভিযানের অংশ বলেও দাবি করা হয়েছে। পুলিশ তার বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘জেলার বিভিন্ন পুলিশ সীমানার মধ্যে এসটিএফ একটি অভিযান চালায়, সেই অভিযানের সময় ৪৪৪ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং নথি যাচাইয়ের জন্য দুটি হোল্ডিং সেন্টারে পাঠানো হয়েছে।’
বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছেন তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সামিরুল ইসলাম। তিনি এ বিষয়ে বৃহত্তর আন্দোলনে নামারও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। ‘এক্স’ হ্যান্ডলে তিনি লিখেছেন, ‘ফের বাংলাভাষী শ্রমিকদের উপর বর্বরতা চালাচ্ছে বিজেপি শাসিত ওড়িশা সরকার। মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, মালদহ, নদিয়া, পূর্ব বর্ধমান ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে যাওয়া শ্রমিকদের শুধু বাংলা বলার অপরাধে বাংলাদেশি সন্দেহে আটক করা হয়েছে।’
সামিরুল সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘বাংলা বলা কি অপরাধ? এই গরিব মানুষগুলোর বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর এত রাগ কেন?’ তিনি জানিয়েছেন, আগেও বহু শ্রমিককে একইভাবে আটক করা হয়েছিল, অথচ কেন্দ্র বা ওড়িশা সরকার তাঁদের অভিযোগকে গুরুত্ব দেয়নি। এবার তাই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে রাজ্য সরকার। তৃণমূল সাংসদের দাবি, বাংলার মুখ্যসচিব ইতিমধ্যেই ওড়িশার মুখ্যসচিবকে চিঠি লিখে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি আরও জানান, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলার মানুষ যদি অন্য রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে এই ধরনের হয়রানির শিকার হন, তাহলে সরকার চুপ করে বসে থাকবে না।
তবে তৃণমূল নেতৃত্বের অভিযোগ, একের পর এক এই ঘটনার নেপথ্যে রাজনৈতিক অভিসন্ধি রয়েছে। তাঁদের প্রশ্ন, আদৌ কি প্রশাসনিক তদন্ত হয়েছে, নাকি শুধুমাত্র ভাষা বা পরিচয়ের ভিত্তিতে এই শ্রমিকদের নিশানা করা হচ্ছে? বাংলা থেকে হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক বিভিন্ন কাজে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যান। তাঁদের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষায় এবার রাজ্য সরকার যে আরও সক্রিয় হচ্ছে, তার ইঙ্গিত স্পষ্ট করে দিয়েছে এই পদক্ষেপ।
ঝাড়সুগুড়া পুলিশ ৪৪৪ জন পরিযায়ী শ্রমিককে আটক করা প্রসঙ্গে তৃণমূলে রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ বলেন, ‘বাংলায় কথা বললেই হেনস্তা। এটা একটা বাজে জায়গায় যাচ্ছে। নথি দেখালেও কেন এই সব করা হচ্ছে। এনআরসি-প্রতিবাদের মাঝেই বহিরাগত বলে আক্রমণ করা হচ্ছে। বিএসএফের হাতে দেওয়া হচ্ছে। তারা আবার বলছে ফিরতে চাইলে গুলি করব।’
উল্লেখ্য, সম্প্রতি উত্তম ব্রজবাসী নামে দিনহাটার এক ব্যক্তিকে বাংলাদেশি তকমা দিয়ে তলব করেছে অসম সরকার। বুধবার কোচবিহারের সর্বত্র দিনহাটার ঘটনা নিয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছে তৃণমূল। এর মাঝেই ঘটে গিয়েছে ওড়িশার ঘটনাটি। বিষয়টি জানার পর ক্ষোভ প্রকাশ করেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, বাংলাভাষীদের মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রে নেমেছে বিজেপি। বাংলার বিরুদ্ধে এটি একটি বড় চক্রান্ত। একইভাবে ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, রাজ্যে ক্ষমতায় আসতে পারবে না বুঝে বিজেপি ঘুরপথে বাংলায় এনআরসি চালুর চেষ্টা করছে।