তৃণমূল নেতাকে খুনের ঘটনায় আটক দলেরই দুই কর্মী! ভাঙড়ে শওকত-আরাবুলের দ্বন্দ্বই কি হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য-কারণ?
আনন্দবাজার | ১১ জুলাই ২০২৫
ভাঙড়ে তৃণমূল নেতা রেজ্জাক খানকে গুলি করে খুনের ঘটনায় দলেরই দুই কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। ঘটনার সময় তাঁরা অকুস্থলে হাজির ছিলেন। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পরেই তাঁদের পাকড়াও করা হয়েছে বলে দাবি পুলিশের। ঘটনার পর আইএসএফ-এর দিকেই আঙুল তুলেছিল শাসক তৃণমূল। পাল্টা আইএসএফ দাবি করে, তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরেই খুন হতে হয়েছে রেজ্জাককে।
পুলিশ সূত্রে খবর, বিজয়গঞ্জ বাজারের দিক থেকে নিজের বাইকে করে বাড়ি ফেরার সময় রেজ্জাককে লক্ষ্য করে গুলি চালায় আততায়ীরা। সেই সময় রেজ্জাকের সঙ্গে তাঁর দুই সঙ্গী ছিলেন। আততায়ীরা গুলি চালানো শুরু করতেই সেখান থেকে পালিয়ে যান তাঁরা। পুলিশ যে দু’জনকে আটক করেছে, তাঁরা সেই দুই সঙ্গীই কি না, তা নিয়ে পুলিশের তরফে সরকারি ভাবে এখনও কিছু জানানো হয়নি। পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, রেজ্জাকের বুকে গুলি করা হয়েছিল। ঘটনাস্থল থেকে চারটি গুলির খোল মিলেছে। শুধু গুলিই নয়, রেজ্জাকের চোখে-মুখেও ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ সূত্র।
এই ঘটনার পর থেকেই চাপা উত্তেজনা তৈরি হয়েছে ভাঙড় জুড়ে। সামনের বছরেই বিধানসভা ভোট হওয়ার কথা রাজ্যে। তার আগে এই ঘটনায় আশঙ্কিত স্থানীয়েরা। তাঁদের একাংশের দাবি, ক্যানিং পূর্বের তৃণমূল বিধায়ক শওকত মোল্লা এবং সাসপেন্ড হওয়া তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলামের দ্বন্দ্বের জেরেই খুন হয়েছেন রেজ্জাক।
ভাঙড়ে এক সময়ে আরাবুল-ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত ছিলেন রেজ্জাক। শুক্রবার সে কথা নিজেও জানিয়েছেন আরাবুল। কান্নায় ভেঙে পড়া প্রাক্তন তৃণমূল নেতা বলেন, ‘‘ক্ষমতায় থাকার সময় রেজ্জাক আমার ছায়াসঙ্গী ছিল। একসঙ্গে অনেক লড়াই, অনেক পরিকল্পনা... একসঙ্গে কত স্মৃতি! ভাবিনি এ ভাবে হারাতে হবে!’’
ভাঙড়ের রাজনীতিতে শওকত-আরাবুল দ্বন্দ্ব নতুন নয়। গত এক দশকে ‘তাজা নেতা’ আরাবুলের দাপট যত কমেছে, ততই বেড়েছে শওকতের প্রভাব। এ কথা সর্বজনবিদিত যে, ভাঙড়ে তৃণমূলের রাজনীতি এখন শওকতেরই নিয়ন্ত্রণে। সম্প্রতি আরাবুল দল থেকে সাসপেন্ডও হয়েছেন। কিন্তু তার পরেও চাপানউতর থামেনি। স্থানীয়দের একাংশের দাবি, দুই শিবিরের মধ্যে দ্বন্দ্বের চোরাস্রোত থেকেই গিয়েছিল। তারই সর্বশেষ পরিণাম রেজ্জাকের খুন!
শওকত অবশ্য গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। উল্টে বৃহস্পতিবার তিনি দাবি করেছিলেন যে, আইএসএফের দুষ্কৃতীরা রেজ্জাকের উপর গুলি চালিয়েছে। পরে তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। সেই অভিযোগ অস্বীকার করে ভাঙড়ের আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকি বলেন, ‘‘প্রশাসন যেন রাজনৈতিক পরিচয় না-দেখে তদন্ত করে। শওকত মোল্লা রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করছেন। ওঁর পুরনো রেকর্ড দেখলেই বোঝা যাবে কী ধরনের রাজনীতি উনি করেন। রেজ্জাক খানের সঙ্গে আইএসএফ-এর সম্পর্ক ভাল ছিল। এটা তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণেই হয়েছে।’’
২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে যখন গোটা রাজ্যে পর্যুদস্ত হয়েছিল তৃণমূল, তখন ভাঙড়ে দলের মুখরক্ষা করেছিলেন আরাবুল। সেই থেকেই রাজ্য রাজনীতিতে আলোচনায় এসেছিলেন তিনি। কিন্তু ২০১১ সালে পরিবর্তনের ভোটে রাজ্যের পালাবদল হলেও, ভাঙড়ে আরাবুল হেরে যান। জয়ী হন সিপিএমের বাদল জমাদার। সেই বছরেই তৎকালীন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের হাত ধরে সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন শওকত। আর তৃণমূলের রাজনীতিতে পশ্চাদ্গমন শুরু হয় আরাবুলের। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে জিতে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হলেও, দলে গুরুত্ব হারাতে থাকেন তিনি। এর পরে ২০১৫ সালে দলবিরোধী কার্যকলাপের জেরে ছ’বছরের জন্য তৃণমূল থেকে সাসপেন্ড করা হয় ‘তাজা নেতা’কে। যদিও মাস আটেকের মধ্যেই দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের তৎকালীন সভাপতি শোভন চট্টোপাধ্যায়ের উদ্যোগে তাঁকে দলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জোড়া ধাক্কা খান আরাবুল। যে রেজ্জাকের সঙ্গে লড়াই করে তাঁর রাজনৈতিক উত্থান, ভাঙড় বিধানসভায় তাঁকেই প্রার্থী করে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ বুজে তা মেনে নেওয়া ছাড়া আরাবুলের উপায় ছিল না। একই সঙ্গে দলের অন্দরে তাঁর ‘প্রবল প্রতিপক্ষ’ শওকতকে ক্যানিং পূর্ব আসন থেকে টিকিট দেয় তৃণমূল। রেজ্জাক-শওকত দু’জনেই জেতেন। আর ভাঙড়ের রাজনীতিতে ক্রমশ তলিয়ে যেতে থাকেন আরাবুল। ২০২৩ সালে পঞ্চায়েত ভোটে জিতে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হলেও তাঁর আর আগের মতো দাপট ছিল না। কারণ, তত দিনে ভাঙড় তৃণমূলের সাংগঠনিক দায়িত্ব চলে গিয়েছে শওকতের হাতে।
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এড়াতে স্থানীয় নেতাদের বাদ দিয়ে চিকিৎসক রেজাউল করিমকে ভাঙড়ে প্রার্থী করেছিল তৃণমূল। কিন্তু সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী আইএসএফ নেতা নওশাদ সেখানে জিতে যান। ওই হারে আরাবুলের বিরুদ্ধেই ‘অন্তর্ঘাতের’ অভিযোগ তুলেছিল তৃণমূলের একাংশ। পরে পঞ্চায়েত ভোটে তাঁকে ‘আহ্বায়ক’ পদ দেওয়া হলেও চাবিকাঠি ছিল শওকতের হাতেই। কিন্তু গত বছর লোকসভা ভোট পর্ব শেষ হতেই ভাঙড়-২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পদ থেকে আরাবুলকে সরিয়ে দেয় তৃণমূল। এর পর থেকেই শওকত-আরাবুল দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। আরাবুল দল থেকে সাসপেন্ড হওয়ার পর তা আরও প্রকট হয়েছে বলেই দাবি স্থানীয়দের একাংশের।