• ‘পোকাধরা চিঁড়ে খেয়েছি, শুতে হয়েছে মেঝেয় কাপড় পেতে’! ওড়িশায় বন্দিদশা কাটিয়ে বাড়ি ফিরেও আতঙ্কে বাংলার ৩৬ জন
    আনন্দবাজার | ১১ জুলাই ২০২৫
  • বন্ড পেপার দেখে বাংলাদেশের রাজশাহি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর জেলা সম্পর্কে প্রশ্ন। ওড়িয়া টানের বাংলা উচ্চারণে বার বার জানতে চাওয়া হয়েছিল, পুঠিয়া, মোহনপুর, বাগমারা, গোদাগাড়ি, শিবগঞ্জ, নাটোর, গুরুদাসপুর এলাকায় কোনও পরিচিত রয়েছেন কি না। আগে কোনও দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল কি না। জবাব ‘হ্যাঁ’ হলেই উত্তরদাতাদের চিহ্নিত করে নিয়ে যাওয়া হয় আলাদা ঘরে। শুরু হয় বাংলাদেশি প্রমাণ করার মরিয়া চেষ্টা। আর যাঁদের উত্তর ‘না’, তাঁদের উপরে শুরু হয় মানসিক অত্যাচার। কখনও শারীরিক নির্যাতনও। ওড়িশা জুড়ে বাংলাদেশি চিহ্নিতকরণের অস্থায়ী ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ থেকে মুক্তি পেয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের পরিযায়ী শ্রমিকেরা। অভিযোগ, বাংলায় কথা বলার ‘অপরাধে’ তাঁদের উপর যখন ওড়িশা পুলিশের অত্যাচার চলছে, তখনই ১০-২০ বছর কাজ করা ঠিকাদারেরা মুখ ফোটাননি। তাঁদের মৌন নিয়েও ক্ষোভ উগরে দিলেন রুজিরুটির জন্য গত কয়েক বছর ভিন্‌রাজ্যে থাকা ওই যুবক ও প্রৌঢ়েরা।

    মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়া থানার তোক্তিপুরের তিন বাসিন্দা রাকিবুল ইসলাম, সাইনুল ইসলাম ও হাসিবুল শেখ দীর্ঘ দিন ধরে ওড়িশার জগৎসিংহপুর জেলার বালিগোদা থানায় ঠিকাদারের অধীনে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতেন। তাঁদের দাবি, ২০ বছর আগে স্থানীয় এক ঠিকাদারের হাত ধরে প্রথম ওড়িশা গিয়েছিলেন। তার পর সেখানেই কেটেছে দু’দশকের কর্মজীবন। ভিন্‌রাজ্যের অনেক ঠিকাদারের সঙ্গে তৈরি হয় পারিবারিক সম্পর্ক।

    কিন্তু চলতি সপ্তাহে হঠাৎই এক দিন কাজের জায়গায় উপস্থিত হয় ওড়িশা পুলিশের তিনটি ভ্যান। শুধুমাত্র বাংলায় কথা বলার ‘অপরাধে’ সেখান থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় হরিহরপাড়ার তিন শ্রমিক-সহ মোট ৩৬ জনকে। রাকিবুলের দাবি, তাঁদের কথা বলার কোনও সুযোগই দেওয়া হয়নি। ওড়িয়া ঠিকাদারদের বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তাঁরা নীরব দর্শক থেকেছেন। রাকিবুলের কথায়, ‘‘আমার কাছে পাসপোর্ট, আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড— সমস্ত পরিচয়পত্র ছিল। দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বলা হয়, পাসপোর্ট কেন করেছি‌! বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তানের সঙ্গে আমার কত দিনের যোগ ইত্যাদি। আমার তো বটেই, আমার বাবা-মায়ের জন্ম কোথায় হয়েছে, কী করতেন, সে সবও জানতে চাওয়া হয়। তার পর বাড়ির লোকের কাছ থেকে ১৯৭৫ সালের আগের জমির দলিল চাইতে বলে পুলিশ। সব কিছু জোগাড় করে দিলেও জুটেছে খুব খারাপ ব্যবহার। ওড়িশা পুলিশ গালাগালি করত আমাদের।’’ সাইনুল শেখ নামে আর এক পরিযায়ী শ্রমিকের মন্তব্য, ‘‘আমরা তো ২০ বছর ধরে ওখানকার (ওড়িশা) ঠিকাদারদের কাছে কাজ করি। ওরা তো জানে যে, আমরা বাংলাদেশি নই। ওদের ভাষায় ওরা পুলিশকে একটু বুঝিয়ে বলতে পারত। কিন্তু একদম চুপ করে রইল।’’

    ওড়িশার ঝাড়সুগুদা, জগৎসিংহপুর, জাজপুর, কেন্দ্রপাড়া, কোরাপুট, ভদ্রক জেলার একাধিক জায়গায় অস্থায়ী ভাবে তৈরি হয়েছে ‘ডিটেনশন ক্যাম্প।’ জগৎসিংহপুর জেলার ১৫টি থানার মধ্যে ১২টিতে চলছে অস্থায়ী শিবির। কোথাও তিন দিন, আবার কোথাও তিন সপ্তাহ আটকে রাখা হয় বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের।

    বন্দিদশায় কেমন ছিলেন? প্রায় দশ দিন বন্দি থাকার পর মুক্ত নদিয়ার নুরসেলিম শেখ, আনোয়ার হোসেনরা জানাচ্ছেন, সকালের খাবারে চিঁড়ে আর গুড় দেওয়া হত। অর্ধেক চিঁড়েতে পোকা ভর্তি। দু’বেলা ডাল-ভাত আর আলু সেদ্ধ দেওয়া হত। তবে সে খাবারও সকলে পাননি। ডিটেনশন ক্যাম্পের মেঝেয় কাপড় বিছিয়ে শুতে হত। আতঙ্ক ও ভয়ে দু’চোখের পাতা এক হত না তাঁদের। যাঁরা আটকে আছেন, তাঁদের জন্য চিন্তিত ওই পরিযায়ী শ্রমিকেরা।

    উল্লেখ্য, গত ২৫ জুন ওড়িশায় কাজ করতে যাওয়া পশ্চিমবঙ্গের ১৬ জন শ্রমিককে আটক করে সে রাজ্যের পুলিশ। বাংলাদেশি সন্দেহে তাঁদের আটক করার খবর প্রকাশিত হয় আনন্দবাজার ডট কমে। এর পর একের পর আটকের খবর মিলেছে। বৃহস্পতিবার এ নিয়ে কলকাতা হাই কোর্টের প্রশ্নের মুখে পড়ে রাজ্য। সরকার জানিয়েছে ওড়িশা সরকারের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। আটকদের ফেরানো হয়েছে। তবে এখনও কেউ আটক রয়েছেন কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)