• খড়্গপুর কলেজেও অধ্যাপনা করেছেন জীবনানন্দ দাশ
    এই সময় | ১২ জুলাই ২০২৫
  • সুদীপ জোয়ারদার

    চল্লিশের দশকের শেষ দিক। চেষ্টা করেও কলকাতার আশপাশে একটা কাজ জোগাড় করতে পারছেন না জীবনানন্দ। কবি জীবনানন্দ দাশ। এর আগের চাকরি, বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের স্মৃতি ভালো নয়। উপরন্তু দেশভাগ। কলকাতায় থাকবেন, থেকে যাবেন ভেবেই বরিশাল ছেড়ে এসেছেন।

    কিন্তু কাজ কই? এই সময়ে কাজের একটা সুযোগ এল মেদিনীপুর থেকে। ১৯৪৮ সালে মেদিনীপুরে তৈরি হওয়া খড়্গপুর কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে তিনি নির্বাচিত হলেন। ১৯৫০ সালের ২ সেপ্টেম্বর কবি যোগ দিলেন রেলশহরের সেই কলেজে।

    সদ্য তৈরি হওয়া কলেজটির তখনও নিজস্ব ভবন তৈরি হয়নি। ক্লাস হতো সিলভার জুবিলি হাইস্কুলে। সেখানকারই ছাত্রাবাসের একটি ঘরে জীবনানন্দের থাকার ব্যবস্থা হলো।

    কাজে থিতু না-হতে পারার ঘটনা জীবনানন্দের যেন ভবিতব্য। এ ক্ষেত্রেও তেমনটাই হলো। খড়্গপুর কলেজে তাঁর স্থিতি খুব কম, মাত্র পাঁচ মাস বারো দিন। কিন্তু এই সময়কাল আরও প্রলম্বিত হতেই পারত। কারণ, জায়গাটিকে কবি ভালোবাসতে শুরু করেছিলেন। তাঁর কবিতা নিয়ে কোনও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ এখানে ছিল না।

    তাঁর কবিখ্যাতি এখানে কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রেই শুধু নয়, কাজ করার ক্ষেত্রেও সহায়ক হয়েছিল। কেউ তাঁর পড়ানোর দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেনি। মালঞ্চর একটি বিদ্যালয়ে কবিজায়ার একটা কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল বলে তিনি এখানে পাকাপাকি থাকার কথাও ভাবতে শুরু করেছিলেন।

    কিন্তু বাধ সেধেছিল দূরত্ব। কন্যা মঞ্জুশ্রী পিসি সুচরিতার কাছে তমলুকে থাকত। তাকে নিয়ে চিন্তা ছিল না। কিন্তু কলকাতায় স্ত্রী ও বারো বছরের পুত্র সমরানন্দকে রেখে ১২০ কিমি দূরের রেলশহরে তিনি খুব শান্তিতে সময় কাটাতে পারতেন না। চিন্তিত থাকতেন বেশিরভাগ সময়ে।

    একবার সপ্তাহান্তে ছুটিতে এসে দেখেন, স্ত্রী লাবণ্য প্রবল অসুস্থ। জানা গেল, তাঁর ‘অ্যাঞ্জাইনা’ হয়েছে। হার্ট খুব দুর্বল। জীবনানন্দ স্ত্রীর পরিচর্যায় লেগে রইলেন। কলেজ রইল পড়ে। কলেজে দরখাস্ত দিয়ে কয়েকদিনের ছুটি অবশ্য পেলেন।

    কিন্তু স্ত্রী আর সুস্থ হন না। প্রায় চার মাস ভুগলেন লাবণ্য। তিনি নিজেও সেই সময়ে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই কলেজে তিনি অনেকদিন অনুপস্থিত। ছুটির জন্য আবেদন জানালেন কলেজ কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু তাঁর ছুটির আবেদন অগ্রাহ্য হলো। তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হলো- ‘Your service is no longer required.’

    খড়্গপুরের দিনগুলো কেমন ছিল জীবনানন্দের? জানা যায়, কলেজে পড়ানোর সময়টুকু বাদ দিয়ে তিনি ছাত্রাবাসের ঘরটিতেই দরজা বন্ধ করে থাকতেন। ডাকলেও দরজা খুলতেন না।

    একমাত্র ছাত্রাবাসের দায়িত্বে থাকা সংস্কৃতের অধ্যাপক পুলিনবিহারী পালের ডাক অগ্রাহ্য করতেন না। দরজা বন্ধ করে কবি পড়াশোনা, লেখালেখি নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। কবি চিরকাল সন্ধেয় হাঁটতে ভালোবাসতেন। হয়তো এখানেও সন্ধেবেলায় তিনি হাঁটতে বেরোতেন। যদিও এ নিয়ে সঠিক কিছু জানা যায় না।

    পাণ্ডুলিপিভর্তি একটি স্যুটকেস কবি বরিশাল থেকে বয়ে নিয়ে এসেছিলেন। এটি খোয়া গিয়েছিল মেচেদা থেকে হাওড়াগামী একটি লোকাল ট্রেনে। পরে অবশ্য এই স্যুটকেসের কিছু লেখাপত্র কলকাতা পুলিশ উদ্ধার করে।

    স্যুটকেসের পরে কবি একটি ট্রাঙ্ক ব্যবহার করতেন। জীবনানন্দ মেদিনীপুরের ছাত্রবাসের ঘরটিতে বসে ট্রাঙ্কের কাগজপত্র ঘাঁটছেন, আর কেউ এলেই সেটি আড়াল করে ফেলছেন, এমন কথাও লিখে গিয়েছেন অনেকে।

    যে কলেজে তাঁর ছুটির আবেদন একদা অগ্রাহ্য হয়েছিল, পরে সেই কলেজেই বসানো হয়েছে তাঁর আবক্ষমূর্তি। কলেজের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবের বছরে কবির জন্মদিন, ১৭ফেব্রুয়ারি মুর্তিটি বসানো হয়। মুর্তিটি তৈরি করেন শিল্পী সুধীর মাইতি।

    (লেখক পেশায় শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)

  • Link to this news (এই সময়)