সুমন তেওয়ারি, আসানসোল: বর্ষায় দীঘায় মৎস্যজীবীদের জালে উঠছে ইলিশ। সেই টাটকা ইলিশের টানে রাতে দীঘার উদ্দেশে বেরনোই কাল হল আসানসোলের চার বাসিন্দার। পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলদার কাছে তাঁদের চারচাকা গাড়ির সঙ্গে লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত সকলেই আসানসোল উত্তর থানার করুণাময়ী হাউজিংয়ের বাসিন্দা। সকলের পেশা ভিন্ন, বয়স আলাদা হলেও সবাই এক পরিবারের মতোই থাকেন। একসঙ্গে আবাসনের চারজনের মৃত্যুতে বাকরুদ্ধ এলাকার বাসিন্দারা। শুধু মৃতদের পরিবার নয়, প্রায় সব বাড়িতে ভাতের হাঁড়ি চাপেনি। মোড়ে মোড়ে জটলায় দুর্ঘটনা নিয়ে আলোচনা। প্রিয়জনের মৃত্যুর খবর পেয়ে পরিবারের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন শিক্ষক হিমাদ্রিশেখর পাত্র। তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাথমিক শিক্ষক সংগঠনের প্রাক্তন জেলা সভাপতি। সময়টা ভালো যাচ্ছিল না তাঁর। পরপর বাড়িতে অসুস্থতা লেগেই ছিল। প্রতিবেশীদের দাবি, কিছুদিন আগে বাবা, স্ত্রী ও ছেলে তিনজনকেই ভেলোরে নিয়ে গিয়ে অপারেশন করিয়ে এনেছিলেন হিমাদ্রিবাবু। দীর্ঘদিন পর কিছুটা স্বস্তি ফিরেছিল সংসারে। তাই পরিচিত বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে মানসিকভাবে স্বস্তি পেতে দীঘার উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন। তা যে সকলের ‘শেষযাত্রা’ হবে তা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি পরিবারের সদস্যরা।
মৃত কার্তিক লাহিড়ি আসানসোল পুরসভার পরিচিত ঠিকাদার। তাঁর মেয়ে অনিন্দিতা বেঙ্গালুরুতে বিএসসি নার্সিং পড়ছেন। স্ত্রী সন্তোষী গৃহবধূ। কার্তিকবাবুর ভাই তুলসী লাহিড়ি বলেন, বর্ষায় ইলিশ খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল ওদের। শনি ও রবিবার দীঘায় থেকে মোহনার টাটকা ইলিশ নিয়ে বাড়ি ফিরবে ভেবেছিল। রাত সাড়ে ১১টায় বাড়ি থেকে বের হয়েছিল। ভোরে আমরা দুর্ঘটনার খবর পাই। বউদি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। তিনিই জানান, দাদার সঙ্গে মারা গিয়েছেন অতনু গুহ। খবর শোনার পরই তাঁর স্ত্রী মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বাড়িতে তাঁকে অক্সিজেন দিতে হচ্ছে। তাঁদের এক নাবালক সন্তান রয়েছে।
দুর্ঘটনায় মৃত বিশ্বজিৎ মণ্ডল একটি বেসরকারি কোলিয়ারিতে কাজ করতেন। স্কুলশিক্ষিকা স্ত্রী ও বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে থাকতেন বিশ্বজিৎবাবু। ছেলের মৃত্যুতে শোকে পাথর হয়ে গিয়েছেন তাঁর বাবা, মা। তাঁর আত্মীয় সোমনাথ মণ্ডল বলেন, এভাবে ওর মৃত্যু হবে দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। পরিবারকে সামলোই কঠিন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, সোসাইটির সদস্যদের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকায় সন্ধ্যা হলেই জমিয়ে আড্ডা হয়। সেই আড্ডাতেই বর্ষায় সমুদ্র সৈকত দেখতে যাওয়ার প্রসঙ্গ ওঠে। সঙ্গে ইলিশ নিয়ে বাড়ি ফেরার পরিকল্পনা ছিল। তাঁদের সঙ্গে যাওয়ার কথা ছিল সুকুমার পালের। তিনি বলেন, সামনের শীতে পরিবারের সকলে দীঘা যাবে বলে বলল। তাই আমি শেষ মুহূর্তে ওদের সঙ্গে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করি। আমারও হয়তো একই পরিণতি হতো।
স্থানীয় কাউন্সিলার অনির্বাণ দাস বলেন, ওঁরা দীঘায় পৌঁছেছেন কি না জানতে বন্ধুরাই ফোন করেছিলেন। তখনই পুলিস ফোন ধরে দুর্ঘটনার খবর দেয়। তারপরই এখান থেকে গাড়িতে করে সবাই ঘটনাস্থলের উদ্দেশে রওনা দেন। প্রদেশ কংগ্রেস সম্পাদক প্রসেনজিৎ পুইতণ্ডি ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিবারের পাশে দাঁড়ান। সোশ্যাল মিডিয়ায় শোক প্রকাশ করেন মন্ত্রী মলয় ঘটক, মেয়র থেকে বিধায়করা।