নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: ইনস্টাগ্রামে ‘প্রোফাইল নেম’ ছিল পরমানন্দ জৈন। আলাপ সেখানেই। মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন তিনি। আর তরুণী নিজে কাউন্সেলিং করেন। ফলে স্বার্থের তাগিদেই পরিচয় খানিক গভীর হল। শুরু হল মেসেজে কথাবার্তা। সমস্যার কথা বললেন পরমানন্দ। উত্তরে কিছু পরামর্শও এল। কিন্তু এভাবে তো পাকাপাকি সমাধান হবে না! তার জন্য কাউন্সেলিং সেশন প্রয়োজন। এই ঘটনাক্রম চার মাস আগের। শুরু হল সেশন। পরমানন্দ জৈন পড়েন আইআইএম জোকায়। দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। থাকেন হস্টেলেই। দু’বার এলেন তরুণী। কাউন্সেলিং করলেন। ফিরে গেলেন। কয়েকদিন আগেই আবার ফোন পেলেন তিনি। লাইনের ওপারে পরমানন্দ। আর একটা সেশন চাই। দিন ঠিক হয় ১১ জুলাই। সকাল ১১টা। আইআইএম জোকার বয়েজ হস্টেলেই। রাতে ওই হস্টেলের ১৫১ নম্বর ঘরই অপরাধ এবং খবরের শিরোনামে।
পূর্ব ভারতে ম্যানেজমেন্ট শিক্ষার পীঠস্থানে ধর্ষণের ঘটনা? তোলপাড় পড়েছে গোটা দেশে। দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মানে আর কয়েক মাস পরই পাশ করে বেরবেন। কোটি টাকার চাকরি বাঁধা। তাঁর এমন প্রবৃত্তি! শুক্রবার গভীর রাত থেকে এমন সব প্রতিক্রিয়া ঘুরতে শুরু করেছে মহানগরের বাতাসে। ক্যাম্পাসের মেইন গেটে নাম রেজিস্টার করতে না দেওয়া, হস্টেলের ঘরে নিয়ে গিয়ে পিৎজা ও পানীয় দেওয়া, তারপর আচ্ছন্ন অবস্থায় তরুণীকে মারধর এবং ধর্ষণ। পুলিস একটা বিষয়ে নিশ্চিত, পুরোটাই হয়েছে প্ল্যানমাফিক। তাই তরুণী ক্যাম্পাসে আসার আগেই সবটা গুছিয়ে রেখেছিলেন অভিযুক্ত যুবক। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল, এই ধর্ষণের কি ভিডিওগ্রাফি করা হয়েছে? এদিন অভিযুক্তকে আদালতে তোলা হলে তদন্তকারী অফিসার নিজেই এই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ভরা এজলাসে দাঁড়িয়ে তিনি বিচারককে জানিয়েছেন, ‘এই ঘটনার ভিডিও তোলা হয়েছে কি না এবং তা সার্কুলেট করা হয়েছে কি না, তা তদন্তসাপেক্ষ। সেই কারণে অভিযুক্তের মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। সেটির ফরেন্সিক পরীক্ষা হবে। পাশাপাশি, এই ঘটনার পুনর্নির্মাণ প্রয়োজন।’ এরপরই অভিযুক্তকে হেফাজতে নেওয়ার আবেদন জানায় পুলিস। সেই আর্জি মেনে আগামী ১৯ জুলাই পর্যন্ত পরমানন্দ জৈনকে পুলিস হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।
কিন্তু এই পড়ুয়ার নাম আসলে কী? এখানেও প্রাথমিকভাবে ধন্দে ছিল পুলিস। কারণ, ইনস্টাগ্রামে রাহুল জৈন নামেও তাঁর একটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। কিন্তু জানা গিয়েছে, তাঁর আসল নাম প্রেমানন্দ মহাবীর টোপ্পান্নাভার। কর্ণাটকের বাসিন্দা। আশপাশে খোঁজ নিয়ে পুলিস জেনেছে, এই যুবকের ‘পার্টি’ করা এবং বহিরাগত তরুণীদের নিয়ে আসার রেকর্ড রয়েইছে। কিন্তু ধর্ষণ! পুলিস যে বিষয়টির শেষ পর্যন্ত যাবে, সে ব্যাপারে স্পষ্ট করে দিয়েছেন তদন্তকারী অফিসারও। ইতিমধ্যেই রেজিস্টার বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিস। নিরাপত্তারক্ষীর বয়ান নেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে চাওয়া হয়েছে সিসি ক্যামেরার ফুটেজও। সকাল ১১টা নাগাদ ক্যাম্পাসে ঢুকেছিলেন নির্যাতিতা। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়েছিলেন সন্ধ্যা পর্যন্ত। হস্টেলের কেউ তা দেখল না? উপস্থিত বাকি পড়ুয়াদের ভূমিকা কী ছিল? পুলিস জেনেছে, চারজনের উপস্থিতির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে। তারা কারা? এই সবই রয়েছে হরিদেবপুর থানার স্ক্যানারে।
কিন্তু তরুণীর আসা যাওয়া রেজিস্টার হল না কেন? পুলিস সূত্রে খবর, অভিযুক্ত জানিয়েছেন, সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলারের আসার ব্যাপারে হস্টেল ওয়ার্ডেনকে তিনি আগেই বলে রেখেছিলেন। ঢাল করা হয়েছিল এই ‘মৌখিক’ দাবিকেই। নিরাপত্তারক্ষী জানিয়েছেন, নির্যাতিতাকে আত্মীয়া বলে পরিচয় দিয়েছিলেন পরমানন্দ। তাই খাতায় নামধাম লেখা হয়নি। আবার ওয়ার্ডেন কিন্তু জানিয়েছেন, পড়ুয়া মোটেও তাঁকে তরুণীর আসার ব্যাপারে ‘ইনফর্ম’ করেননি। বেলা ১১টা থেকে ১১টা ৪৫ পর্যন্ত কাউন্সেলিং করেন তরুণী। তারপর তাঁকে পিৎজা খেতে দেন পরমানন্দ। সঙ্গে কোল্ড ড্রিঙ্ক। তাতেই মেশানো ছিল ঘুমের ওষুধ। ঘটনাস্থল থেকে সেই ওষুধের পাতাও পেয়েছে পুলিস। ইতিমধ্যে ওই ছাত্রের জামাকাপড়ও বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিস। নমুনা সংগ্রহ হয়েছে। তরুণী অবশ্য প্রাথমিকভাবে ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে রাজি হননি। পুলিস যদিও তাতে পিছু হটেনি। নির্যাতিতার গোপন জবানবন্দি ও মেডিকো লিগ্যালের তোড়জোড় শুরু হয়েছে।