• ত্রাতা সেই আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ, হেমোরেজিক সিভিএ-র চিকিৎসায় প্রাণ ফিরল তিন ব্যক্তির!...
    আজকাল | ১৪ জুলাই ২০২৫
  • গোপাল সাহা 

    সমস্ত বিতর্ক ছাপিয়ে আবারও শিরোনামে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতাল। তিন মুমূর্ষ রোগীকে একপ্রকার প্রাণ দান করল আরজিকরের নিউরো বিভাগের স্বনামধন্য চিকিৎসকরা। 

    রোগের নামটি শুনলেই ঘাবড়ে যেতে হয় 'হেমোরেজিক সিভিএ' অর্থাৎ মস্তিষ্কের শিরা ফেটে গিয়ে রক্তপাত। আর এই রক্তপাত যদি বেশি মাত্রায় হয় এবং একাধিক বার হয় তাহলে সেই রোগীকে প্রাণে বাঁচিয়ে ফেরানো একেবারেই অসম্ভব বলে দাবি করছেন চিকিৎসাকরা। আর ঠিক সেখানেই একপ্রকার মিরাকেল ঘটালেন আরজিকর হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক অরুণ কুমার পাল ও অঙ্কন মন্ডল সহ তার সহকারী চিকিৎসকরা। 

     'হেমোরেজিক সিভিএ' কি একটু দেখে নেওয়া যাক : 

    * চিকিৎসক বিশেষজ্ঞদের মতে 'হেমোরেজিক সিভিএ' অর্থাৎ মস্তিষ্কের শিরা উপশিরা ফেটে গিয়ে রক্তপাত। হেমারেজ থেকে হেমোরেজিক এবং সিভিএ অর্থাৎ সেরিব্রোভাসকুলার এক্সিডেন্ট, যেখানে মাথায় মস্তিষ্কের আর্টারিতে অ্যনিউরিজন হয় অর্থাৎ বেলুনের মতো ফুলে যায় (অ্যনিউরিজম ডায়লেটেশন হওয়ার কারণে), ফলে অ্যনিউরিজম রাপচার অর্থাৎ সেই বেলুনের মতো ফুলে গিয়ে ফেটে যায় এবং রক্তপাত হওয়া শুরু হয়। আর এর ফলে প্রাথমিকভাবে ভয়ংকর মাথাব্যথা শুরু হয়, আর দ্বিতীয়বার হলে অর্থাৎ রক্তপাত হলে (re-rupture) তাকে বাঁচানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। উল্লেখ্য, এই অ্যানইউরিজনকে টাইম বোম এর সাথে ও তুলনা করা হয় কারণ, এই বেলুনের মতো ফুলে যাওয়া শিরা উপশিরা যদি যেকোনো মুহূর্তে ফেটে যায় তাহলে মানুষের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটে। 

    এর দুটি প্রধান ধরন:  

    ১. ইস্কেমিক স্ট্রোক — রক্তনালী ব্লক হয়ে মস্তিষ্কে অক্সিজেন পৌঁছায় না (প্রায় ৮৫% কেস),

    ২. হেমোরেজিক স্ট্রোক — রক্তনালী ফেটে মস্তিষ্কের ভেতরে বা চারপাশে রক্তক্ষরণ হয় (প্রায় ১৫% কেস)।

    2. হেমোরেজিক সিভিএ / স্ট্রোকের কারণ

    * উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension) — প্রধান কারণ

    * মস্তিষ্কের অ্যানিউরিজম (blood vessel wall দুর্বল হয়ে ফোলানো, যা ফেটে যেতে পারে) AV malformation (arteriovenous malformation)

    * রক্তজমাট বাঁধার ওষুধ (Anticoagulant) অতিরিক্ত নেওয়া

    * মাথায় আঘাত (Trauma)

    3. কীভাবে হয়?

    * মস্তিষ্কের আর্টারির দেয়াল দুর্বল হয়ে অ্যানিউরিজম হয় (বেলুনের মতো ফুলে যায়)।

    * যখন প্রেশার বেড়ে যায়, তখন সেই দেয়াল ফেটে যায় → রক্তক্ষরণ (hemorrhage) শুরু হয়।

    * মস্তিষ্কে রক্ত জমে গিয়ে প্রেশার তৈরি করে (Intracranial pressure বৃদ্ধি পায়), যার ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা ব্যাহত হয়।

    4. লক্ষণসমূহ

    * হঠাৎ ভয়ংকর মাথাব্যথা (“thunderclap headache”) — রোগী বলে “জীবনের সবচেয়ে খারাপ মাথাব্যথা”

    * বমি বমি ভাব বা বমি

    * এক দিকের হাত-পা অবশ (প্যারালাইসিস)

    * কথা জড়িয়ে যাওয়া

    * চেতনা কমে যাওয়া বা অচেতন হয়ে পড়া

    * চোখের দৃষ্টি সমস্যা 

    5. চিকিৎসা কী?

    * জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতাল এ ভর্তি

    * মস্তিষ্কের সিটি স্ক্যান (CT scan) বা MRI করে রক্তক্ষরণের স্থান ও পরিমাণ দেখা হয়

    * ওষুধে intracranial pressure কমানো হয় (mannitol, hypertonic saline), ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ করা হয়

    * যদি অ্যানিউরিজম বা AVM ধরা পড়ে → সার্জারি করে ক্লিপিং বা কইলিং করা হয় যাতে আবার ফেটে না যায়।

    * বড় হেমাটোমা হলে → অপারেশন করে সেই রক্ত বের করে intracranial চাপ কমানো হয়।

    আর এই বিষয়টিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করতে পারলে রোগীর সুস্থ হওয়া অর্থাৎ উন্নতি অনেক ভালো হয়। আর সেই চিকিৎসায় একই সাথে তিনজনের অস্ত্রোপচার করে রোগীদের জীবনের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা যাদুকরের মত। উল্লেখ্য, এই সম্পূর্ণ অস্ত্রোপচার হয় অত্যাধুনিক মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে এবং দুর্মূল্য টাইটেনিয়াম ক্লিপ ব্যবহৃত হয়েছে অ্যানিউরিজোমে থেকে রক্তপাত বন্ধ করতে। 

    আজ থেকে ২০ দিন আগের ঘটনা, ২৫ শে জুন রাজ্যের তিন প্রান্ত থেকে তিন রোগী এসে হাজির হয় এই মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ জনিত অসুখ নিয়ে অর্থাৎ 'হেমোরেজিক সেলিব্রোভাস্কুলার অ্যাক্সিডেন্ট' এর কারণে। একাধিক হাসপাতাল ঘুরে অবশেষে স্থান হয় আরজিকর হাসপাতালে। যখন তাদের এই হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় তাদের উপসর্গ ছিল প্রচন্ড মাথা ব্যথা এবং শরীরের একাংশ প্যারালাইসিস। পরিস্থিতি বুঝে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের তিনজনকেই ভর্তি করে নেয় এবং তারপরেই নিউরো বিভাগের দুই ধন্বন্তরি চিকিৎসক বরুন কুমার পাল ও অঙ্কন মন্ডলের তত্ত্বাবধানে এবং তার সহকারী চিকিৎসকদের উপস্থিতিতে ঘটে যায় এক প্রকার ম্যাজিক। ম্যারাথন অস্ত্রোপচারের পর হাসপাতালে তাদেরকে রাখা হয়েছে চিকিৎসকদের পরামর্শ এবং নজরদারিতে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে বর্তমানে তারা তিনজনেই অনেকটাই সুস্থ। তারা নিজেরাই নিজেদের সব কাজ করতে সক্ষম। 

    এ বিষয়ে আজকাল ডট ইন- এর সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছিলেন আরজিকর হাসপাতালে নিউরো বিভাগের দুই প্রখ্যাত চিকিৎসক বরুণ কুমার পাল ও অঙ্কন মণ্ডল। তারা বলেন, "আমরা আমাদের সেরা চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। যখন এই তিনজন রোগী হাসপাতালে আসে তখন আমরাই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম তাদের পরিস্থিতি দেখে। তড়িঘড়ি তিনজনেরই সমস্ত রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমরা সিদ্ধান্ত নিই যত শীঘ্র সম্ভব অস্ত্রোপচার করতে হবে। আর সেই মতই আমরা অস্ত্রোপাচার অর্থাৎ অপারেশন করি আমাদের কর্মজীবন ও শিক্ষাজীবনে সমস্ত অভিজ্ঞতা উজাড় করে দিয়ে। সঙ্গে আমাদের সহযোগীতায় ছিলেন জুনিয়র সহকারী চিকিৎসক কুন্তল বিট্টেল, কৌস্তব । সত্যি আমরা খুশি যে তাদের সেই তিনজনকে জীবনের মূল স্রোতে ফিরিয়ে দিতে পেরেছি।"

    আরও পড়ুন: এয়ার ইন্ডিয়া বিমান দুর্ঘটনা: তদন্ত রিপোর্টে উত্তরের চেয়ে প্রশ্নই তৈরি হল বেশি

    আরও পড়ুন: হুমায়ুনের পরাজয়, শেরশাহের জয়: চৌসা আমের নামকরণ হল কীভাবে?

     
  • Link to this news (আজকাল)