• সোমবার আদালতে বিশেষ জবানবন্দি ‘নির্যাতিতা’-র, আইআইএম জোকায় তরুণীর ঢোকার সময় নিয়ে থাকছে ধন্দ
    আনন্দবাজার | ১৪ জুলাই ২০২৫
  • জোকায় ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট (আইআইএম) কলকাতার হস্টেলে তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগের তদন্তে এ বার পুলিশের ন’সদস্যের বিশেষ তদন্তকারী দল বা সিট গড়া হল। লালবাজার সূত্রের খবর, কলকাতা পুলিশের দক্ষিণ-পশ্চিম ডিভিশনের কমিশনার এক জন এসি-র নেতৃত্বে রবিবার এই দল গঠন করেছেন। দলে রয়েছেন তিন জন মহিলা অফিসার। যদিও ঘটনা সামনে আসার আড়াই দিন পেরিয়েও বহু প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। অভিযোগকারিণী তরুণীর পরিবারের সঙ্গে বার বার কথা বলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ পুলিশ। আজ, সোমবার আদালতে তরুণীর গোপন জবানবন্দির দিন ধার্য হয়েছে। এ দিনই তরুণীর মেডিকো-লিগ্যাল পরীক্ষা হওয়ার কথা। তরুণী তাতে অংশগ্রহণ করবেন কি না, রাত পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। তবে পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে ফাঁক রাখতে চায়না পুলিশ।

    লালবাজারের কর্তাদের দাবি, সিটের সামনে প্রথম কাজ ঘটনার দিন কখন কী ঘটেছে নিশ্চিত হওয়া। এই প্রাথমিক সময়-সারণীই এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট নয় বলে দাবি তদন্তকারীদের। সিটের এক সদস্য জানাচ্ছেন, তরুণীর মোবাইল ফোনের টাওয়ার লোকেশন দেখে জানা গিয়েছে, ঘটনার দিন অর্থাৎ শুক্রবার বেলা ১১টা নাগাদ তিনি ওই ম্যানেজমেন্ট কলেজের ক্যাম্পাসে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি অভিযোগপত্রে কেন বেলা পৌনে ১২টা নাগাদ কলেজে প্রবেশের কথা লিখেছেন, স্পষ্ট নয়। অভিযুক্ত যুবক জেরায় পুলিশকে জানিয়েছে, একটি অ্যাপের মাধ্যমে কয়েক মাস আগে তরুণীর সঙ্গে পরিচয় হয় তার। মনোবিদ ওই তরুণী তাকে কাউন্সেলিং করা শুরু করেন। ঘটনার আগেও দু’বার তিনি ক্যাম্পাসে গিয়েছিলেন। কাউন্সেলিং চলছে, মনোবিদ আসতে পারেন বলে ধৃত যুবক হস্টেলের ওয়ার্ডেনকে জানিয়ে রেখেছিল বলেও দাবি করেছে। সে জন্যই তরুণীকে হাজিরা খাতায় কিছু লিখতে হয়নি বলে ধৃত যুবকের দাবি। জেরায় সে এ-ও জানিয়েছে, বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ছিল কাউন্সেলিংয়ের সময়। কিন্তু ঘটনার দিন কি তরুণী কাউন্সেলিং করেছিলেন? তার পরেই কি অপরাধটি ঘটে? সেই জন্যই কি অপরাধের সময় হিসেবে পৌনে ১২টায় কলেজে প্রবেশের কথা তরুণী লিখেছেন? উত্তর স্পষ্ট নয়।

    ওই তদন্তকারী অফিসার বললেন, “এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতেই ওই কলেজের কর্তৃপক্ষের থেকে আরও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ চাওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত যা ফুটেজ মিলেছে, তাতে ওই ক্যাম্পাসে তরুণীর উপস্থিতির প্রমাণ মিলেছে। তরুণীর ফোনের টাওয়ার লোকেশনও ঘটনার দিন দীর্ঘক্ষণ ওই ক্যাম্পাসেই দেখা গিয়েছে। কিন্তু ঠিক কখন ক্যাম্পাসে ঢুকেছেন, কোথায় কোথায় গিয়েছেন— সবটাই দেখা দরকার। অভিযোগপত্রে দেওয়া বয়ানের সঙ্গে সব তথ্যপ্রমাণ মিলিয়ে দেখা হবে।” পুলিশ জানার চেষ্টা করছে, তরুণীকে ঘটনার দিন কলেজে কে কে দেখেছিলেন এবং কোথায় দেখেছিলেন। এই কারণে সেখানকার নিরাপত্তারক্ষী, ছাত্র এবং কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে চলেছে পুলিশ। এ জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁদের নামের তালিকা চেয়ে পাঠানো হয়েছে। কলেজের হাজিরা খাতাও খতিয়ে দেখতে চান তদন্তকারীরা। ইতিমধ্যেই কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে ক্যাম্পাসে ও হস্টেলে ঢোকার নথির খাতা চাওয়া হয়েছে। শনিবার রাতেই হস্টেলের ঘটনাস্থল থেকে দু’ধরনের মাথার চুল, জলের বোতল-সহ ন’ধরনের নমুনা সংগ্রহ করেন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরা। সিল করে দেওয়া হয়েছে হস্টেলের ওই ঘর। তরুণী ও অভিযুক্তের মোবাইল ফোনের নথিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাতেই তদন্তকারীরা এক রকম নিশ্চিত, তরুণীকে কাউন্সেলিংয়ের নাম করে ডাকা হয়েছিল। তবে অভিযুক্ত যুবকের মানসিক সমস্যা থাকার কোনও প্রমাণ এখনও পাননি তদন্তকারীরা। ওই যুবক কোনও ওষুধও খেত না বলে জানতে পেরেছে পুলিশ। কলকাতায় আসা অভিযুক্তের পরিবারের সঙ্গেও এ বিষয়ে কথা বলেছেন তদন্তকারীরা।

    তবে সিটের কাছে বড় বাধা অভিযোগকারিণীর পরিবারের অবস্থান। তরুণীর বাবা শনিবারই বলেছিলেন, “আমার মেয়ের সঙ্গে এমন কিছুই হয়নি। গাড়ি থেকে পড়ে গিয়ে আঘাত লেগেছিল। পুলিশ অভিযোগ লিখিয়ে নিয়েছে।” এ দিন ওই পরিবার আর প্রকাশ্যে কিছু বলেনি। যদিও পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, ঘনিষ্ঠ মহলে তাঁরা জানিয়েছেন, শুক্রবার নিজের স্কুটারে ওই ক্যাম্পাসে গিয়েছিলেন তরুণী। রাস্তায় একটি অটোর সঙ্গে তরুণীর স্কুটারের ধাক্কা লাগে। এতে অসুস্থ হয়ে পড়লে পুলিশ তরুণীকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে শারীরিক পরীক্ষা করানোর সময়ে তরুণী নিজের নির্যাতনের অভিজ্ঞতার কথা জানান। এর পরেই পুলিশে অভিযোগ লেখা হয়। প্রথম বার স্কুটার থেকে পড়ে যাওয়ার পরে বাবার সঙ্গে কথা হয় তরুণীর। কিন্তু তরুণীর বাবা হাসপাতালে পৌঁছনোর আগেই তাঁকে হরিদেবপুর থানায় নিয়ে যাওয়া হয় বলে পরিবারটির দাবি। পরে তরুণীর বাবা এলে ফের তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই শনিবার ভোর ৪টে পর্যন্ত তরুণীর শারীরিক পরীক্ষার চেষ্টা চলে।

    পুলিশি তদন্ত নিয়ে খোঁচা দিয়ে ইতিমধ্যে অভিযুক্তের পক্ষের আইনজীবীর দাবি, পুলিশ আদালতে রিপোর্ট দিয়ে বেলা পৌনে ১২টা থেকে রাত ৮টা ৩৫ মিনিটের মধ্যে নির্যাতন হয়েছে বলে জানিয়েছে। আবার পুলিশ অভিযোগ পাওয়ার সময়ও লিখেছে ৮টা ৩৫ মিনিট। এক মিনিটের মধ্যে কী করে পুলিশে অভিযোগ দায়ের হয়ে গেল? আইআইএমের শিক্ষাঙ্গন থেকে এফআইআর হওয়া থানার দূরত্বই প্রায় চার কিলোমিটার! যদিও পুলিশের দাবি, এই কারণেই নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন যে তরুণী ঠিক ক’টায় ক্যাম্পাস ছেড়েছিলেন। তার পরে তিনি কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন অভিযোগকারিণীর সঙ্গে কথা বলে তা-ও জানা প্রয়োজন। কিন্তু এ বিষয়ে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলেই পুলিশ সূত্রে খবর।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)