• প্রেসিডেন্সিবেলার স্বপ্নে ফিরলেন গায়ত্রীরা
    আনন্দবাজার | ১৪ জুলাই ২০২৫
  • বিশ্বব্যাপী উত্তর-ঔপনিবেশিক বিদ্যাচর্চার ভারতীয় মুখ তিনি। বিনির্মাণবাদ, অনুবাদচর্চার অন্যতম শ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিক সেই গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক সম্প্রতি সম্মানিত হয়েছেন হলবার্গ পুরস্কারে। নরওয়ে সরকার ও বার্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া এই পুরস্কার মানবিক ও কলাবিদ্যার নোবেল পুরস্কার হিসেবে পরিচিত। প্রাক্তনীর এই কীর্তিকে সম্মান জানিয়ে রবিবার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় সংবর্ধনা দিল গায়ত্রীকে।আন্তর্জাতিক হয়েও একেবারে নিখাদ বাঙালি গায়ত্রীর কথায় যেমন উঠে এল প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তনী হিসেবে তাঁর স্মৃতি, তেমনই তিনি পরিচয় করালেন তাঁর বর্তমান কাজ, দর্শন এবং ভবিষ্যতের ভাবনার সঙ্গে।

    শনিবারই গায়ত্রী মার্ক্স বিষয়ে একটি কর্মশালা করেছেন। সেই চার ঘণ্টার কর্মশালা, গায়ত্রীর শিক্ষকতার সাক্ষী থাকতে পারার ঘোর যে তাঁর পরের দিনও কাটেনি, তা এ দিন জানিয়ে দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নির্মাল্যনারায়ণ চক্রবর্তী।উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধক দেবজ্যোতি কোনারের উপস্থিতিতে সংবর্ধিত করা হল গায়ত্রীকে। ছিলেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এই অনুষ্ঠানের সহ-আয়োজকঅনুষ্টুপ পত্রিকার সম্পাদক অনিল আচার্যও।

    সংবর্ধনা পর্বের পরে গায়ত্রীর সঙ্গে কথোপকথনে ছিলেন তাঁর প্রেসিডেন্সিবেলারই বন্ধু, অধ্যাপক-প্রাবন্ধিক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ইতিহাসবিদ লক্ষ্মীসুব্রহ্মণিয়ান। সভামুখ্য হিসেবে ছিলেন উপাচার্য। এই কথোপকথনের টানে বর্ষণমুখর রবিবাসরীয় বিকেলেও ডিরোজ়িয়ো হল ছিল ভরা। শমীকের সঙ্গে গায়ত্রীর বন্ধুত্বের বয়স পেরিয়েছে সাত দশক। কিন্তু প্রথম আলাপের স্মৃতি এখনও দু’জনের মনে রয়েছে অবিকল। এক আন্তঃকলেজ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় গায়ত্রীর প্রথম হওয়া থেকে তার শুরু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েক বছর পর তাঁদের উচ্চশিক্ষা শুরু। সেই আবহে কী ভাবে তাঁরা এক যুদ্ধমুক্ত, সভ্য পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা উঠে এল দুই বন্ধুর কথায়।

    এখন পৃথিবীতে যা পরিস্থিতি, স্বাধীন মত প্রকাশ করলেই বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। দেশে দেখা যাচ্ছে যুদ্ধ চেয়ে উন্মত্ততা। এমন অবস্থায় তরুণ বয়সে তাঁদের দেখা স্বপ্নকে হার মানতে হয়েছে কি না, শমীক সেই প্রশ্ন করলেন বন্ধুকে। গায়ত্রী জানালেন, এই প্রশ্ন তাঁকেও বিচলিত করে। কিন্তু তার মধ্যেও কাজ করে যাওয়ার কথা জানালেন তিনি। আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার মধ্যেই গায়ত্রী যে নিয়মিত বাংলার গ্রামাঞ্চলে আসেন, তফসিলি জনগোষ্ঠীর জন্য তাঁর স্কুলে পড়ান, সেটাই তাঁকে এই কঠিন সময়ে জীবনীশক্তি দেয়। তা বোঝা যাচ্ছিল, মঞ্চ থেকে বার বার তাঁর স্কুলের সহযোগী সুন্দরী, বুদিন, উজ্জ্বলদের সঙ্গে গায়ত্রীর আলাপেও। গণতন্ত্রের মধ্যে নিহিত অন্তর্দৃষ্টি, শিক্ষার মাধ্যমে কী ভাবে সঞ্চারের কাজই তাঁর বৌদ্ধিক প্রয়াস, তা জানালেন গায়ত্রী।

    বিজ্ঞান বা প্রযুক্তিবিদ্যার মতো অর্থকরী নয় বলে বিশ্ব জুড়ে মানবিক বিদ্যার চর্চার সঙ্কটের কথাও উঠে এল আলোচনায়। হলবার্গ পুরস্কার পাওয়ার পরে এই মানবিক বিদ্যার চর্চার গুরুত্বের কথা জোর দিয়ে বলেছিলেন গায়ত্রী। এ দিনও তিনি মনে করালেন, প্রযুক্তি উন্নত হলেও অপরাধ কমছে না। তা কমাতে পারে শুধুমাত্র মানুষের নৈতিক উন্নতি। তা হতে পারেমানবিক বিদ্যার প্রভাবেই। গায়ত্রীর কথায়, ‘‘এ হল সাংস্কৃতিক স্বাস্থ্য।’’ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দাপটেও মনন ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির, ‘মন দেওয়ার’ গুরুত্ব তাই এখনও অটুট বলেও জানালেন তিনি।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)