• বিহারের পর এবার বাংলা! ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে বাংলায় ঘুরপথে এনআরসি? ...
    আজকাল | ১৫ জুলাই ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক: নির্বাচন কমিশন (ECI) সম্প্রতি এক বিশেষ উদ্যোগ ঘোষণা করেছে—Special Intensive Revision (SIR)—যার প্রাথমিক লক্ষ্য ভোটার তালিকায় কেবলমাত্র যোগ্য ভারতীয় নাগরিকদের অন্তর্ভুক্ত করা। এই প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে বিহার থেকে, যেখানে ২০০৩ সালের পর এই প্রথম এমন ধরনের তালিকা পুনর্বিবেচনা হতে চলেছে। নির্বাচন কমিশনের ভাষায়, এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে “নগরায়ন, অভ্যন্তরীণ অভিবাসন ও অবৈধ অনুপ্রবেশ” জনিত কারণে ভোটার তালিকার বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখার জন্য।

    তবে এই পদক্ষেপকে ঘিরে পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক ও নাগরিক স্তরে প্রবল উদ্বেগ। বহু বিশ্লেষকের মতে, এই তালিকা সংশোধনের নামে বাংলায় কার্যত এনআরসি চালু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। সোশ্যাল মিডিয়া ও রাজনৈতিক আলোচনায় ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে—নাগরিকত্ব যাচাইয়ের নামে কি নতুন করে বাংলার মুসলিম ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে নিশানা করা হচ্ছে?

    কী বলছে নির্বাচন কমিশন?

    ২৪ জুন, ২০২৫ তারিখে জারি হওয়া এক নির্দেশিকায় নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, যেসব ভোটার ২০০৩ সালের ভোটার তালিকায় ছিলেন না, তাদের নাগরিকত্বের প্রমাণ দাখিল করতে হবে। সেই সঙ্গে দিতে হবে নিজের জন্মস্থান ও নাগরিকত্ব সংক্রান্ত একটি স্বঘোষিত বিবৃতি।

    ভোটারদের তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে—

    ১. ১ জুলাই ১৯৮৭ সালের আগে জন্মেছেন: এই শ্রেণির ভোটারদের শুধু জন্ম তারিখ বা জন্মস্থানের প্রমাণ দিলেই চলবে।

    ২. ১ জুলাই ১৯৮৭ থেকে ২ ডিসেম্বর ২০০৪ সালের মধ্যে জন্মেছেন: তাদের নিজের পাশাপাশি বাবা বা মায়ের নাগরিকত্ব প্রমাণপত্র দাখিল করতে হবে।

    ৩. ২ ডিসেম্বর ২০০৪-এর পরে জন্মেছেন: এদের ক্ষেত্রে নিজের এবং বাবা-মা উভয়ের নাগরিকত্বের প্রমাণ জমা দিতে হবে।

    নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য ১১টি গ্রহণযোগ্য নথির যে কোনও একটি দিলেই চলবে। এর মধ্যে রয়েছে জন্ম সার্টিফিকেট, পাসপোর্ট, শিক্ষাগত সার্টিফিকেট, জমির দলিল, কাস্ট সার্টিফিকেট ইত্যাদি। বার্থ সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক নয়।

    আরও পড়ুন: জয়শঙ্করের বেইজিং সফরে ভারত-চীন সম্পর্ক উন্নয়নের ইঙ্গিত

    বিভ্রান্তি কোথায়?

    সমস্যার মূল উৎস হল বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা ও প্রচার। অনেকেই ভুল করে ধরে নিচ্ছেন যে, শুধু মাত্র জন্ম সার্টিফিকেট  না থাকলে ভোটার তালিকায় নাম তোলা যাবে না। এর ফলে রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে উদ্বেগ ও ভীতি। বিশেষ করে দরিদ্র, গ্রামীণ ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই আতঙ্ক বেশি।

    ভারতের Birth and Death Registration Act চালু হয় ১৯৬৯ সালে। তবে বাস্তবে ৯০ দশকের শেষ পর্যন্ত অধিকাংশ গ্রামীণ বা পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে জন্মসনদের ধারণা বা রেকর্ড রাখা ছিল বিরল। ফলে আজ অনেকের পক্ষেই এই ডকুমেন্ট জোগাড় করা দুষ্কর। তার উপর যাদের বাবা-মায়ের জন্ম সার্টিফিকেট নেই, তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণ দেওয়া আরও জটিল।

    অনলাইন সুবিধা ও স্বচ্ছতা

    নির্বাচন কমিশনের দাবি, এই গোটা প্রক্রিয়াটি যথাসম্ভব স্বচ্ছভাবে পরিচালিত হবে। BLO (Booth Level Officer) দের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফর্ম বিতরণ এবং ডকুমেন্ট সংগ্রহ করা হবে। প্রয়োজনে ECINET অ্যাপ ব্যবহার করে অনলাইনে আবেদন করা যাবে। শারীরিক প্রতিবন্ধী ও বয়স্কদের জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের সাহায্যও থাকবে।

    রাজনীতি ও আশঙ্কা

    অন্যদিকে কংগ্রেস ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলি অভিযোগ করেছে যে, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভোটার তালিকা থেকে অসংখ্য বৈধ নাগরিকের নাম বাদ দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বহুবার অভিযোগ করেছেন যে, বিজেপি সরকারের আমলে ভোটার তালিকা 'ম্যানিপুলেট' করা হচ্ছে।

    বাংলায় এমন উদ্যোগ আদতে নাগরিকত্ব নিয়ে নতুন করে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকেই। বিশেষত, এনআরসি ও CAA নিয়ে যেভাবে গত বছরগুলোতে পশ্চিমবঙ্গে তীব্র আন্দোলন হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এই পদক্ষেপ নতুন করে রাজনৈতিক উত্তাপ সৃষ্টি করতে পারে।

    নির্বাচন কমিশনের এই পদক্ষেপ ভোটার তালিকার স্বচ্ছতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে হলেও, এর প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যে যেন তেন আচরণ হবে না—তা নিশ্চিত করাটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নাগরিকদের সচেতনতা ও সঠিক তথ্য জানাটাই এই মুহূর্তে প্রয়োজন। কারণ বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়লে প্রকৃত ভোটাররাও বাদ পড়তে পারেন, যা গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক।
  • Link to this news (আজকাল)