হাতে কাঁটা ফুটেছে জানিয়েও রেহাই মেলেনি, উল্টে মারধর, জেলার পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে বর্বরতা ছত্তিশগড়ে
বর্তমান | ১৬ জুলাই ২০২৫
নিজস্ব প্রতিনিধি কৃষ্ণনগর: ‘স্যর, হাতে কাঁটা ফুটে যাচ্ছে। আর পারছি না।’ ঝোপ-জঙ্গল সাফ করার সময় পুলিসকে জানিয়েছিলেন নদীয়ার পরিযায়ী শ্রমিকরা। কিন্তু, তাতে কর্ণপাত করেনি পুলিস। উল্টে কাজ করতে না চাওয়ায় সবার কপালে জোটে অশ্রাব্য ভাষার গালিগালাজ ও বেধড়ক মারধর। বাংলাদেশি সন্দেহে পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে এমনই মধ্যযুগীয় বর্বরতার ঘটনা ঘটেছে বিজেপি শাসিত ছত্তিশগড় রাজ্যে। ওড়িশায় নদীয়ার পরিযায়ী শ্রমিকদের আটকে রাখার পর এবার ছত্তিশগড়ে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। কর্মক্ষেত্র থেকে পরিযায়ী শ্রমিকদের তুলে আনা। বাংলাদেশি কিনা যাচাই করা। তাঁদের দিয়ে জোর করে জঙ্গল পরিস্কার করানো। মদের বোতল তোলানোর মতো কাজ করানো হয়েছে। ছাড়া পাওয়ার পর এমনই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন পরিযায়ী শ্রমিকরা। কৃষ্ণনগর লোকসভার সাংসদ মহুয়া মৈত্র যাকে ‘রাষ্ট্রীয় অপহরণ’ বলে দাবি করেছেন। যদিও সোমবার রাতেই পরিযায়ী শ্রমিকদের নিজেদের কাজের জায়গায় ফেরাতে বাধ্য হয়েছে ছত্তিশগড়ের পুলিস।
সাংসদ বলেন, ‘হেবিয়াস কর্পাস পিটিশন করা হয়েছে। তারপর পরিযায়ী শ্রমিকদের ছাড়া হয়েছে। ক্ষতিপূরণ এবং অবৈধভাবে আটকে রাখা নিয়ে মামলা করানো হচ্ছে। বৈধ নথিপত্র থাকা সত্ত্বেও ১২৮ বিএনএসএস ধারাতে পরিযায়ী শ্রমিকদের অবৈধভাবে জেলেও বন্দি করা হয়েছে। অন্যায়ভাবে এসব করা হচ্ছে।’
নদীয়া জেলার থানারপাড়া থানার অন্তর্গত মথুরাপুর এলাকার ৯ জন শ্রমিক গতমাসের ২৮ জুন ছত্তিশগড়ের রাজমিস্ত্রির কাজ করতে গিয়েছিলেন। গত ১২ জুলাই শনিবার দুপুরে সাড়ে বারোটা নাগাদ তাঁদের পুলিস তুলে নিয়ে যায়। তারপর সেখানে বাংলাদেশি সন্দেহে একটি বাড়িতে রেখে প্রথমে বেধড়ক মারধর করে। যদিও পরিচয়পত্র হিসেবে প্রথমেই তাঁরা আধার কার্ড দেখিয়েছিলেন। তারপর ঘর থেকে বের করে এনে কাঁটাযুক্ত ঝোপ-জঙ্গল সাফাইয়ের কাজে লাগানো হয় তাঁদের। তাতে বেশ কয়েকজনের হাতও কেটে যায়।
পরিযায়ী শ্রমিক রহিম শেখ বলেন, ‘হাতে কাঁটা বিঁধে যাওয়ার কথা ওঁদের বলেছিলাম। তা শুনেই আমাদের ফের মারধর করা শুরু করে। আমাদের দিয়ে প্রায় চার ঘন্টা জঙ্গল পরিস্কার করানো হয়েছিল। সন্ধ্যার সময় সেখান থেকে এক কিলোমিটার দূরে আমাদের একটা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে আমাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়। তারপর আমাদের জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমরা আমাদের ও পরিবারের সকলের পরিচয়পত্র দেখিয়েছিলাম।’ আর এক পরিযায়ী শ্রমিক সোহেল শেখ বলেন, ‘আমরা বারবার তাঁদের বলছিলাম, আমরা পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। কিন্তু ওরা বাংলাদেশি সন্দেহে আমাদের মারধর করছিল। আমরা হিন্দিতে ওদের সঙ্গে কথা বলতে পারছিলাম না।’
সম্প্রতি, নদীয়া জেলায় কালীগঞ্জ ও নাকাশিপাড়া থানা এলাকার প্রায় ৪০ জন পরিযায়ী শ্রমিককে বাংলাদেশি সন্দেহে ওড়িশার অঘোষিত ডিটেনশন ক্যাম্পে অবৈধভাবে টানা পাঁচদিন আটকে রাখার অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু ছত্তিশগড়ের ঘটনায় আইনের অপব্যবহার করে ঘুরপথে পরিযায়ী শ্রমিকরা বাংলাদেশি কিনা যাচাই করা হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, ১২৮ বিএনএসএস ধারাকে ঢাল করা হচ্ছে। কারণ এই ধারা অনুযায়ী, কেউ নিজের পরিচয় লুকিয়ে রেখে অপরাধ করতে পারে এই সন্দেহে ধরা যায়। তখন ম্যাজিস্ট্রেট সেই ব্যক্তিকে তার ভালো আচরণের জন্য মুচলেকা দিতে বলতে পারেন। সম্প্রতি ওই এলাকায় নাকি বিগত বেশ কয়েকদিন ধরে ধর্ষণ, চুরির মতো ঘটনা ঘটছিল। আর সেটা নাকি করছিল ভিনরাজ্য থেকে আসা পরিযায়ী শ্রমিকরা। তাই নদীয়ার পরিযায়ী শ্রমিকদের পরিচয়পত্র যাচাই করার জন্যই আনা হয়েছিল। এমনটাই সেখানকার এসপি জানিয়েছিলেন সাংসদ মহুয়া মৈত্রকে।