• পেশায় শিক্ষক, নেশায় সাপুড়ে, ভিডিওকলে নিজে সাপের কামড় খেয়ে বাঁচিয়েছিলেন একটি পরিবারকে...
    আজকাল | ১৭ জুলাই ২০২৫
  •  আজকাল ওয়েবডেস্ক: পেশায় তিনি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক।  কিন্তু লোকে বলে নেশায় তিনি সাপুড়ে। ১৭৯৬ সালে ওড়িশার গঞ্জাম শহরে 'স্যামডিস কন্ডানেরাস' নামে একটি বিরলতম প্রজাতির সাপ উদ্ধারের ঘটনার প্রায় ২১৮ বছর পর প্রলয় চ্যাটার্জী মুর্শিদাবাদের ফরাক্কা ব্লকের নিশিন্দ্রা এলাকা থেকে উদ্ধার করেছেন ওই প্রজাতির আরও একটি সাপ। এর আগে পশ্চিমবঙ্গের কোথাও ওই প্রজাতির সাপের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। 

    আজও মুর্শিদাবাদের ফরাক্কা ব্লক এবং ব্লক সংলগ্ন কোনও প্রত্যন্ত গ্রামে সাপ দেখতে পেলে স্থানীয় গ্রামবাসীরা বনদপ্তরের কর্মীদের ফোন করার আগে প্রলয় চ্যাটার্জীকে ফোন করেন। বহু বছর ধরে তিনি গ্রাম এবং শহরাঞ্চলের সাধারণ মানুষকে  সাপ সম্পর্কে সচেতন করে চলেছেন। 

    উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরের বাসিন্দা প্রলয় চ্যাটার্জী বর্তমানে ফরাক্কা ব্লকের বলিদাপুকুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহ শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। বছরে আটত্রিশের এই শিক্ষক বর্তমানে পেশার কারণে ফরাক্কা দু'নম্বর কলোনির বাড়িতে একাই থাকেন। তবে প্রলয়ের পেশা শিক্ষকতা হলেও নেশা সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন প্রজাতির সাপ সম্পর্কে সচেতন করা এবং সাপেদের সুরক্ষিতভাবে উদ্ধার করে তাদের স্বাভাবিক বাসস্থানে ফিরিয়ে দেওয়া। 

    তিনি বলেন,' প্রায় ১৪ বছর আগে আমি যখন গ্রামের বাড়িতে থাকতাম সেই সময় একটি কলেজের কিছু ছাত্র-ছাত্রী আমাদের গ্রামে এসে সাপ সম্পর্কে সচেতনতা শিবির করেছিল। তা দেখেই সাপ সংরক্ষণ এবং তাদের উদ্ধার করার ইচ্ছা জাগে আমার মধ্যে।' 

    প্রলয় এরপর বেশ কয়েক বছর নিজের মতো করে  গ্রামের বাড়িতে ছোটখাটো সাপ উদ্ধার করেছেন এবং সাপ উদ্ধারকারী দলের সদস্যদের সঙ্গে থেকে কীভাবে বিভিন্ন রকমের সাপ উদ্ধার করতে হয় তা শিখেছেন। তিনি বলেন,' শখের নেশায় নেমে পড়ার পর প্রথম ৪-৫ বছর আমি বিষধর সাপের গায়ে একদমই হাত দিতাম না। তবে নির্বিষ সাপের গায়ে  মাঝেমধ্যে হাত দিয়েছি। কারণ সেই সময় আমার  সাপ ধরা এবং উদ্ধার সম্পর্কে যথাযথ প্রশিক্ষণ ছিল না। এরপর বেশ কিছু বিজ্ঞান কর্মী এবং বনদপ্তরের কর্মীদের সঙ্গে থেকে আমি দীর্ঘদিন ধরে সাপ ধরার প্রশিক্ষণ নিয়েছি।' তিনি বলেন,' আজ অবধি আমি প্রায় হাজারের উপর সাপ উদ্ধার করেছি। তারপরও বলছি কখনই  কোনো একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির সাপের চরিত্র সম্পর্কে  নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়।  আমি ২০০-র বেশি চন্দ্রবোড়া সাপ ধরেছি কিন্তু তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই চরিত্র আলাদা মনে হয়েছে।' গ্রামবাসীদের ডাকে সাড়া দিয়ে ফরাক্কা ব্লকের বিভিন্ন জায়গায় সাপ ধরলেও প্রলয়  কারও কাছ থেকে কোনও টাকা নেন না। নিজের মোটরসাইকেলে তেল ভরে সাপ ধরতে যাওয়া থেকে শুরু করে সেটিকে  সুরক্ষিতভাবে ছেড়ে দেওয়া পর্যন্ত সবটাই  এই শিক্ষক নিজের ব্যক্তিগত উদ্যোগে করে থাকেন। তিনি বলেন,' অনেক লোক সাপ ধরার জন্য  টাকা নেয় কিন্তু আমি কোনও বাড়ি থেকে সাপ ধরলে সেদিন তাঁর বাড়িতে চা পর্যন্ত খাই না।' প্রলয় বলেন,' বর্তমানে ফেসবুক-ইউটিউবের যুগে অনেকেই দ্রুত বিখ্যাত হওয়ার জন্য বিষধর সাপের সঙ্গে বিভিন্ন রকম খেলা দেখাতে গিয়ে মৃত্যুর মুখে পর্যন্ত পড়ছেন।'  মালদার এক যুবকের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন ,'ওই যুবক খুব ভালো সাপ ধরতেন। সমাজমাধ্যমে একটি চ্যানেল খুলে তার জন্য ভিডিও শ্যুট করতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনেন এবং সাপের কামড়ে তাঁর মৃত্যু হয়।' তাঁর কথায় 'অনেকেই সন্দেহ করেন সাপ ধরার পর আমি হয়তো সেই সাপের বিষ বের করে বেআইনিভাবে  কোথাও বিক্রি করি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সাপ ধরার পর তার 'জিও ট্যাগিং' করা ছবি এবং ভিডিও আমি বনদপ্তরের কাছে পাঠিয়ে দিই। এরপর বনদপ্তরের অনুমতি নিয়ে যথাযথভাবে সেই সাপ ছেড়ে দিই। অনেক সময় বনদপ্তরের কর্মীরাও আমার কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া বিষধর সাপ নিয়ে গিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় ছেড়ে দেন।' সাপ ধরা শুরু করার পর থেকে এখনও সেই নেশা ছাড়তে পারেননি প্রলয়। তিনি বলেন, 'গত দু'দিনে আমি ফরাক্কায় সাতটা চন্দ্রবোড়া সাপ ধরেছি। আমাদের রাজ্যে যে সমস্ত সাপ পাওয়া যায় তার মধ্যে চন্দ্রবোড়া,সিন্ধু কালাচ , গোখরো, কেউটে অত্যন্ত বিষধর। তাই যারা সাপ চেনেন না তাঁদের উচিত এই সরীসৃপ প্রাণীকে না মেরে তাদের সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া।' শখের 'সাপুড়ে' প্রলয় নিজের কর্মস্থল থেকে যেখানেই যান সঙ্গে সাপ ধরার হুক, টং, গামবুট নিতে ভোলেন না।  সাপের কামড় খাওয়ার এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে প্রলয় বলেন,'একবার ফরাক্কা ব্লকের একটি বাচ্চাকে নির্বিষ সাপে কামড়েছিল। ওই বাচ্চাটির পরিবারের লোকেরা ভয় পেয়ে তাকে হাসপাতাল নিয়ে যায়। সেই সময় ভিন রাজ্যে কর্মরত শিশুটির বাবা ভিডিও কলে চিৎকার করে হুমকি দিতে থাকেন তাঁর ছেলের কিছু হলে সে পরিবারের সকলকে খুন করে ফেলবে। সেই সময় ওই ব্যক্তিকে শান্ত করার জন্য আমি সাপটিকে নিয়ে এসে ভিডিও কল চলাকালীন লোকটিকে দেখিয়ে ওই সাপের কামড় খেয়েছিলাম এবং তাঁকে শান্ত করেছিলাম।'

    বুধবার 'বিশ্ব সর্প দিবসে' সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যে বার্তা দিয়ে এই শিক্ষক বলেন,' সাপকে যদি আপনার ভয় লাগে তাহলে তাকে না মেরে তার থেকে দূরে থাকুন। আর যদি সম্ভব হয় সাপের গায়ে ঠান্ডা জল দিয়ে দিন। তাহলে সাপ নিজের থেকেই এলাকা থেকে পালিয়ে যাবে।'
  • Link to this news (আজকাল)