• দলের সহযোগী সংস্থার ‘শুদ্ধিকরণ’ অভিযান, দুয়ারে গিয়ে হাঁড়ির খবর ফাঁস, সঙ্গে হুঁশিয়ারি, তাজ্জব তৃণমূল নেতারা
    বর্তমান | ১৭ জুলাই ২০২৫
  • সুখেন্দু পাল  বর্ধমান

    আপনার অমুক মৌজায় এত পরিমাণ জমি রয়েছে। আপনি এইসব লোকেদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। এক ঠিকাদারের সঙ্গে আপনার বিরাট দহরম মহরম। আপনার আয়ের সোর্সও আমরা জানি...। ‘গোয়েন্দাগিরি’তে উঠে আসা এমন সব তথ্য দুয়ারে গিয়ে ফাঁস করে দিলে কারই বা মন ভালো থাকে? যাকে বলে একেবারে হাঁড়ির খবর! আর সেই ব্যক্তি যদি হন জনপ্রতিনিধি কিংবা নেতা, তা হলে তো ভিড়মি খাবেনই। ঠিক যেমনটা হচ্ছে বর্ধমানের একাংশ তৃণমূল নেতা-নেত্রীদের! 

    বছর ঘুরলেই বিধানসভার ভোট। তার আগে জনমানসে দলের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে একাধিক কর্মসূচি নিয়েছে তৃণমূলের সহযোগী সংস্থা। রাজনীতির কারবারিরা যাকে বলছেন ‘শুদ্ধিকরণ অভিযান’। আর তাতেই এখন ত্রাহি ত্রাহি রব আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়ে ওঠা শাসকদলের নেতাদের মধ্যে। শুধু গোপন তথ্য জানিয়েই থেমে থাকছেন না সংস্থার প্রতিনিধিরা। শোনাচ্ছেন কড়া কথাও—‘এবার শুধরে যান। তা না হলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার।’

    নিরবচ্ছিন্ন ৩৪ বছরের বাম শাসনে সিপিএমের অনেক নেতাই হাওয়াই চটি পরতেন। প্রকাশ্যে বিড়ি ফুঁকতেন। ছেঁড়া জামা-কাপড় পড়ে ঘুরে বেড়াতেন। যাতে গরিব পার্টির কর্মী হিসেবে জনমানসে দাগ কাটতে পারেন। এইসব ‘গরিবি’ ভাবের বাম নেতারা পরে অভিযুক্ত হয়েছেন নানা দুর্নীতিতে। তাঁদের বিরুদ্ধে নামে-বেনামে কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি বানানোরও অভিযোগ উঠেছে। সেই সব নেতাদের সবক শেখাতে একদা সিপিএমেও ‘শুদ্ধিকরণ’ অভিযান চলেছিল। 

    রাজনৈতিক মহল মনে করে, রাজ্যে পালা বদলের পরও শাসকদলের একাংশ নেতা বাম আমলের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন। তবে, তাঁরা অনেকটাই খুল্লামখুল্লা। গলায় একাধিক সোনার হার, আংটি, দামি ব্র্যান্ডের পোশাক পরে ঘুরে বেড়ান। অনেকে আবার গোপনে বিপুল সম্পত্তির মালিকও। তাঁদের এহেন কর্মকাণ্ড জনমানসে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। ক্ষোভ পুঞ্জিভুত হচ্ছে দলীয় কর্মীদের মধ্যেও। সেই কারণেই সহযোগী সংস্থাকে দিয়ে ‘শুদ্ধিকরণ অভিযান’-এ নেমেছে শাসকদল। 

    তৃণমূল সূত্রে খবর, সহযোগী সংস্থাটি প্রতিটি স্তরের নেতাদের সম্পর্কে আগেই খুঁটিনাটি তথ্য সংগ্রহ করেছে। কার সঙ্গে বালির ঘাট বা ঠিকাদারদের নিবিড় যোগ রয়েছে, কার কত সম্পত্তি, কার ব্যাঙ্ক ব্যালান্স কত—এই রকম নানা  তথ্য সংস্থার তালুবন্দি। সেগুলি নিয়েই নেতাদের দুয়ারে পৌঁছে যাচ্ছেন বিশেষ টিম। গিয়েই একের এক তথ্য ফাঁস। শুনে চমকে যাচ্ছেন নেতারা। ক’দিন আগে সংস্থার প্রতিনিধিরা তায়নার এক নেতার কাছে গিয়েছিলেন। তিনি আগুন্তুকদের সামনে পেয়ে দলের হয়ে ‘লড়াই’-এর কাহিনি শোনাতে শুরু করেন। কিছুটা শুনেই সংস্থার এক কর্মী প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘আপনার বর্ধমানেও বাড়ি রয়েছে না? ওখানেই রাতে থাকেন? থতমত খেয়ে যান ওই নেতা। বর্ধমান শহরে বিলাসবহুল বাড়ির কথা তো ঘনিষ্ঠ বৃত্ত ছাড়া কেউই জানে না! তা হলে এঁরা পেলেন কিভাবে? ভ্যাবাচাকা খেয়ে ভাবছেন। তার মধ্যেই  ওই নেতার অতীত ঘেঁটে বর্তমান সময়ে উত্তরণ শুনিয়ে দিলেন সংস্থার প্রতিনিধি।

    তায়নার ওই নেতা একটা উদাহরণ মাত্র। সংস্থার প্রতিনিধিরা ব্লক থেকে অঞ্চল সভাপতি সবার কাছে গিয়েই সংগৃহীত হাঁড়ির খবর উজাড় করে দিচ্ছেন। সতর্কও করছেন। না শোধরালে ভবিষ্যৎ খারাপ হবে বলেও জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তৃণমূলের এক নেতা বলছিলেন, এই অভিযানের মধ্য দিয়ে প্রার্থী বাছাইয়ের প্রস্তুতিও চলছে। সংস্থার কর্মীরা তাঁদের কাছেই গিয়ে জানতে চাইছেন, ‘বলুন তো, আপনার এলাকায় কাকে প্রার্থী করা যায়?’ মুচকি হেসে অনেকেই জবাব দিচ্ছেন, ‘আমার কথা ভাবতে পারেন।’ তারপরই তাঁকে শুনিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাঁর কীর্তি-কাহিনি। কিছুক্ষণ থেমে নেতা বলছেন, ‘আপনাদের কাছে তো সব খবর রয়েছে। আপনারা যাকে সমর্থন করবেন তাঁকেই মানতে হবে।’  
  • Link to this news (বর্তমান)