• দুই গাড়ির ধাক্কা খাওয়া জেলায় ছুটবে শিল্পায়নের ‘বন্দে ভারত’! হিন্দমোটরের জঙ্গলে সম্ভাবনার বীজ নবান্নের, সংশয়ী বিরোধীরা
    আনন্দবাজার | ১৭ জুলাই ২০২৫
  • অ্যাম্বাসেডর থেকে ন্যানো। সিঙ্গুর থেকে হিন্দমোটর। ঘরপোড়া হুগলি গাড়ির কথা শুনলেই ডরায়! কিন্তু সেই হুগলিতেই ফের নতুন শিল্প সম্ভাবনা। তবে এ বার গাড়ি নয়। রেলের কোচ নির্মাণ।

    যে কোনও থানার আশপাশে আগাছায় ঢাকা পরিত্যক্ত গাড়ি স্বাভাবিক দৃশ্য। কিন্তু গত ১০ বছর ধরে আস্ত একটি গাড়ি কারখানা পরিত্যক্ত দশায় পড়ে রয়েছে ব্যস্ত জনপদের ধারে। সাফ হয়ে গিয়েছে শেড। বহুলাংশ ঢেকেছে ঘন জঙ্গলে। হুগলির হিন্দমোটর কারখানার সেই জঙ্গল সরিয়ে শিল্পায়নের নতুন সম্ভাবনার বীজ পুঁতেছে নবান্ন। বন্দে ভারত এক্সপ্রেস এবং মেট্রোর কোচ তৈরির বরাত পাওয়া টিটাগড় রেল সিস্টেম্স লিমিটেডকে হিন্দমোটরের কারখানার ৪০ একর জমি ৯৯ বছরে লিজ়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভা। বিনিময়ে রাজ্য সরকার পাবে ১২৬ কোটি টাকা। যাকে ‘মরদেহে প্রাণ সঞ্জীবন’ হিসাবে অভিহিত করছে শাসক তৃণমূল। আর বিরোধী বাম-বিজেপির বক্তব্য, শিল্প হলে ভাল। তবে মমতার রাজ্যে শিল্পায়ন খানিকটা কাঁঠালের আমসত্ত্বের মতো। ঘোষণা হয়, কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না।

    ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের অব্যবহিত পরেই ‘সাসপেনশন অফ ওয়ার্ক’-এর নোটিস ঝুলেছিল হিন্দমোটরের গেটে। তার পর থেকে সেই তালা আর খোলেনি। যে কারখানায় দীর্ঘ ৫৭ বছর ধরে তৈরি হয়েছে মরিস অক্সফোর্ড সিরিজ়ের অ্যাম্বাসেডর, সেই জমিই পরিণত হয়েছে জঙ্গল ঢাকা ‘ভূতের বাসা’য়। স্থানীয়দের অনেকে রসিকতা করে বলেন, গত ১১ বছর ধরে হিন্দমোটরের জমিতে ‘ভূতেরা’ রাজত্ব করেছে। তারাই খুলে নিয়ে গিয়েছে শেড এবং গাড়ি তৈরির যন্ত্রাংশ। এমনকি, ট্রাক ট্রাক মাটিও যেন কী ভাবে উবে গিয়েছে!

    সেই অন্ধকারের পাশে সামান্য হলেও আলো রয়েছে। চালু রয়েছে টিটাগড় ওয়াগন কারখানা। যে সংস্থা মূলত রেলের কোচ তৈরি করে। তারাই এ বার বড় অঙ্কের বরাত পেয়েছে মেট্রো এবং বন্দে ভারতের কোচ তৈরির। এই সংস্থারই ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে বছর তিনেক আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, কারখানা সম্প্রসারণের প্রয়োজনে রাজ্য সরকার লাগোয়া এলাকায় জমি দেওয়ার চেষ্টা করবে। সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে তাতেই সিলমোহর পড়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই শাসকদল তৃণমূল রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তকে ‘মাইলফলক’ বলে অভিহিত করছে। পাল্টা সংশয় প্রকাশ করছে বিরোধীরা। শ্রীরামপুরের সাংসদ (হিন্দমোটর কারখানা পড়ে এই লোকসভা কেন্দ্রেই) কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্ত যুগান্তকারী। আবার ওই এলাকায় জনসমাগম ঘটবে। মানুষ কাজ পাবেন। শক্তিশালী হবে অর্থনীতি। সিপিএম শিল্পায়নের লাশ রেখে গিয়েছিল। মমতাদির সরকার তাতে প্রাণ সঞ্চার করছে।’’

    পাল্টা বামেদের তরফে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, আদালতের রায় থাকা সত্ত্বেও বন্ধ হয়ে যাওয়া হিন্দমোটর কারখানার শ্রমিকদের শর্তগুলি পূরণ না-করে কী ভাবে জমি হস্তান্তর করা হল? সিটুর হুগলি জেলার সাধারণ সম্পাদক তীর্থঙ্কর রায়ের বক্তব্য, ‘‘শিল্পের জমিতে শিল্প হোক সেটা আমাদেরই দাবি। কিন্তু ভবিষ্যৎ বলবে কী হচ্ছে। এ রাজ্যে সবই আসলে ‘ভূত’। ঘোষণা হয়, কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না।’’ পাশাপাশি তাঁর এ-ও বক্তব্য, ‘‘আদালতের কাছে আমরা জানতে চাইব, কী ভাবে নির্দেশ লঙ্ঘিত করে রাজ্য সরকার জমি দিল?’’ উল্লেখ্য, ২০২৪ সালে কারখানা বন্ধ হওয়ার পরে একাধিক মামলা হয়েছিল হাই কোর্টে। তারই একটি অন্তর্বর্তী নির্দেশে আদালত বলেছিল, শ্রমিক-কর্মচারীদের বিষয়গুলি মীমাংসা না-হওয়া পর্যন্ত জমির স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে হবে। যদিও তৃণমূলের নেতারা একান্ত আলোচনায় বলছেন, আইনি বিষয়গুলি দেখে নিয়েই রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিজেপি-র শ্রীরামপুর সাংগঠনিক জেলার সভাপতি সুমন ঘোষের কথায়, ‘‘বাংলা একমাত্র রাজ্য যেখান থেকে ন্যানো চলে গিয়েছে। নতুন কারখানা তৈরি হয়নি বরং তোলাবাজিতে বন্ধ হয়েছে। শিল্পায়ন হোক আমরাও চাই। তবে যত ক্ষণ না হচ্ছে, তত ক্ষণ বিশ্বাস করা কঠিন।’’

    প্রসঙ্গত, আদালত রায় দিয়ে দিয়েছে যে, হিন্দমোটর কারখানার জমি রাজ্য সরকার দিতে পারবে। বুধবার সুপ্রিম কোর্ট রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে। শীর্ষ আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, হিন্দমোটর কারখানার ৩৯৫ একর জমি ফিরিয়ে নেওয়ার অধিকার রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের। সুপ্রিম কোর্ট এ-ও উল্লেখ করেছে যে, ওই জমি এখন বড় মাপের রেলের কোচ তৈরির কারখানার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। সরকারি জমি জনস্বার্থেই ব্যবহৃত হওয়া উচিত। হিন্দুস্তান মোটর্‌স লিমিটেড অ্যাম্বাসেডর কারখানা তৈরির জন্য বরাদ্দ ৩৯৫ একর জমি ফিরিয়ে নিতে রাজ্য় সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রথমে জমি ট্রাইব্যুনাল এবং তার পরে কলকাতা হাই কোর্টে গিয়েছিল। হাই কোর্ট গত মে মাসে রাজ্য সরকারের পক্ষেই রায় দেয়। তার পরে ওই সংস্থা গিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বিভি নাগরত্ন এবং বিচারপতি কেভি বিশ্বনাথনের বেঞ্চ কলকাতা হাইকোর্টের রায়ই বহাল রেখেছে।

    ১৯৫৭ সালে গাড়ি তৈরি শুরু করেছিল ‘হিন্দুস্তান মোটর্‌স লিমিটেড’। বিড়লা গোষ্ঠীর সংস্থা গোড়ায় অ্যাম্বাসেডরের পাশাপাশি তৈরি করত ল্যান্ডমাস্টার মোটর গাড়িও। পরে অবশ্য শুধুই অ্যাম্বাসেডর নির্মাণের জন্য খ্যাতি পায় হিন্দমোটর। বন্ধ হওয়ার বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই ধুঁকতে শুরু করেছিল হিন্দমোটর। তার অন্যতম কারণ গাড়ির বাজারে প্রতিযোগিতা। বাম জমানায় হিন্দমোটরের পুনরুজ্জীবনের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, ট্যাক্সি পরিবহণে অ্যাম্বাসেডর ছাড়া অন্য কোনও গাড়ি ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু তাতেও উৎপাদন বৃদ্ধির বদলে ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছিল। কারখানার এক শ্রমিকের কথায়, ‘‘মাসে যখন ৭০০-৭৫০টি গাড়ি উৎপন্ন হচ্ছিল, তখনও পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই তা ২৫০-৩০০ হয়ে যায়। তখনই সঙ্কট তীব্র হয়।’’

    প্রসঙ্গত, একটা সময়ে ছ’বছরের মধ্যে দু’বার গাড়ির ধাক্কা খেয়েছে হুগলি জেলার শিল্পায়ন। ২০০৮ সালে সিঙ্গুর থেকে ন্যানো প্রকল্প প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করেছিল টাটা গোষ্ঠী। ২০১৪ সালে বন্ধ হয়ে যায় হিন্দমোটর। এর মধ্যে বন্ধ হয়েছে ব্যান্ডেলের সাহাগঞ্জের ডানলপ কারখানাও। যেখানে তৈরি হত টায়ার। একের পর এক আলো নিবতে থাকা জেলায় এখন নতুন শিল্প সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ওয়াকিবহাল মহলের অনেকের মতে, কারখানার অভ্যন্তরীণ পরিকাঠামো নতুন করে গড়তে হলেও টিটাগড় ওয়াগন বাইরের পরিকাঠামো তৈরিই পাবে। পাশেই রয়েছে রেললাইন, সড়ক পরিবহণেও রয়েছে বিস্তর সুবিধা। ৩ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে জাতীয় সড়ক (দিল্লি রোড)। যা সম্প্রসারিত হয়ে এখন ঝাঁ চকচকে।

    বন্ধ হয়ে যাওয়া, জঙ্গলে ঢেকে যাওয়া জমিতে কি আলো জ্বলবে? অপেক্ষায় উত্তরপাড়া। অপেক্ষায় হুগলির শিল্পাঞ্চলও।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)