বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিতে বাঙালিদের উপর অত্যাচার কোনও ভাবেই বরদাস্ত করা হবে না। বুধবারের প্রতিবাদ মিছিল থেকে সেই বার্তাই দিলেন তৃণমূল চেয়ারপার্সন তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কলেজ স্কোয়্যার থেকে ডোরিনা ক্রসিং পর্যন্ত মিছিল করেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বাঙালি নিপীড়নের প্রতিবাদে এই মিছিল থেকে সর্ব ধর্ম সমন্বয়েরও বার্তা দিলেন মমতা।
মিছিলের একেবারে সামনের সারিতে মমতা-অভিষেকদের সঙ্গে হাঁটতে দেখা গেল এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এবং এক মুসলিম মৌলবিকে। মমতা-অভিষেকদের একেবারে ডান দিকে হাঁটলেন তাঁরা। পরে ডোরিনা ক্রসিংয়ের মঞ্চে পৌঁছে যখন সকলকে ধন্যবাদ জানাচ্ছিলেন মমতা, তখনও আলাদা করে এই দু’জনের নাম উল্লেখ করেন তিনি। মনে করা হচ্ছে, এর মধ্যে দিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলার ঐক্য এবং সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের বার্তা দিতে চেয়েছেন তৃণমূলনেত্রী। মিছিলের সামনের সারিতে মমতা-অভিষেকদের সঙ্গে ছিলেন কলকাতার মেয়র তথা মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। অরূপ বিশ্বাস, সুজিত বসু, শশী পাঁজা, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের মতো মন্ত্রীরাও ছিলেন মিছিলের সামনের সারিতে। ছিলেন বিধায়ক নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
বিধাননগরের মেয়র কৃষ্ণা চক্রবর্তী, বিধাননগর পুরসভার চেয়ারম্যান তথা দলের বারাসত সাংগঠনিক জেলার চেয়ারপার্সন সব্যসাচী দত্ত, যুব তৃণমূলের সভানেত্রী সায়নী ঘোষ এবং তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসির সভাপতি ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়কেও দেখা যায় মিছিলে মমতা-অভিষেকদের সঙ্গে। ডোরিনা ক্রসিংয়ের মঞ্চে মমতা-অভিষেকদের সঙ্গে দেখা গিয়েছে মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কেও।
মিছিল শেষে মমতার প্রায় প্রায় পৌনে এক ঘণ্টার বক্তৃতায় সিংহভাগ জুড়েই রইল বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিতে বাঙালিদের হেনস্থার অভিযোগ। কেন্দ্রীয় সরকার গোপনে একটি বিজ্ঞপ্তি বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিতে পাঠিয়ে দিয়েছে বলেও অভিযোগ মমতার। তৃণমূলনেত্রীর অভিযোগ, ওই বিজ্ঞপ্তির ফলেই বাঙালিদের উপর অত্যাচার বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি বলেন, “ভারত সরকার একটি নোটিফিকেশন করেছে। সেই নোটিফিকেশনটা আমরা চ্যালেঞ্জ করব। লুকিয়ে লুকিয়ে (নোটিফিকেশনটি) করেছে এবং যেখানে যেখানে বিজেপি আছে, সেখানে পাঠিয়েছে। তাতে পরিষ্কার বলা হয়েছে, যাকেই সন্দেহ হবে, বাংলায় কথা বলে, অ্যারেস্ট করবে, ডিটেনশন ক্যাম্পে (হোল্ডিং এরিয়ায়) রেখে দেবে।” এমনকি কেউ আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেলেও তাঁদের এই হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ মমতার। তিনি বলেন, “ভারত সরকার এবং বিজেপির এই আচরণে আমি অত্যন্ত লজ্জিত, ব্যথিত, দুঃখিত এবং মর্মাহত।”
পরে মমতা সমাজমাধ্যমে লেখেন, “আমি চুপ থাকব না, যতক্ষণ না বিজেপি এই বিভাজনের রাজনীতি বন্ধ না করবে। তাদের অপপ্রচার-কুৎসার বিরুদ্ধে জবাব দেওয়ার সময় এসেছে।”
ডোরিনা ক্রসিংয়ের মঞ্চে বক্তৃতা না করলেও সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের বার্তা উঠে এসেছে অভিষেকের সমাজমাধ্যম পোস্টে। তিনি লেখেছেন, “বাংলা ভাষা এবং বাঙালির সম্মান রক্ষার লড়াইয়ে, মুষলধারে বৃষ্টি উপেক্ষা করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যাঁরা মহামিছিলে পা মেলালেন, তাঁদের সবাইকে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।”
বিজেপিশাসিত রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর অত্যাচার এবং ‘বাংলাদেশি’ তকমা দিয়ে আটক করাকে ‘গণতন্ত্রের উপর পরিকল্পিত আক্রমণ’ বলেই ব্যাখ্যা করছেন অভিষেক। সমাজমাধ্যমে তিনি লেখেন, “বিজেপির মনে রাখা উচিত যে, ‘বাংলা ভাষার অপমান - বাংলার অপমান’। বাংলাভাষী শ্রমিকদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে আমাদের দল বদ্ধপরিকর। বিজেপি-শাসিত রাজ্যে গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত।”
তৃণমূলনেত্রী স্পষ্ট করে দেন, অন্য ভাষাভাষী মানুষদের তিনি সম্মান করেন। প্রত্যেক ভারতীয়কেই সম্মান করেন। কিন্তু বাঙালির উপর অত্যাচার তিনি সহ্য করবেন না। আধার কার্ড, প্যান কার্ড থাকার পরেও পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দাদের কেন বাংলাদেশি বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন মমতার। পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ীদের উপর ভিন্রাজ্যে হেনস্থার অভিযোগ তুলে মমতার অভিযোগ, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। ওই বিজ্ঞপ্তির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “যাকেই সন্দেহ হবে জেলে নিয়ে এক মাস রেখে দিতে পারো। বিনা বিচারে এক মাস রেখে দেবেন? এটা কী! এ তো জরুরি অবস্থার থেকেও বেশি।”
সম্প্রতি অস্বাস্থ্যকর খাবারের প্রসঙ্গে দেশবাসীকে সতর্ক করতে কেন্দ্রের পরামর্শাবলিতে শিঙাড়া-জিলিপির প্রসঙ্গ টানা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। বুধবার ডোরিনা ক্রসিংয়ের বক্তৃতা থেকে তা নিয়ে ফের কেন্দ্রকে নিশানা করেন মমতা। তিনি বুঝিয়ে দেন, কে কী খাবেন, কী পরবেন, কে কোন ভাষায় কথা বলবেন, তা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত বিষয়। এ প্রসঙ্গে মন্তব্যের সময় শিঙাড়া-জিলিপির পাশাপাশি পোহা, ধোসা, ইডলি, ঠেকুয়া, হালুয়ার প্রসঙ্গও টানেন মমতা। শুধু বাংলা নয়, দেশের প্রতিটি প্রান্তের মানুষ এবং তাঁদের খাদ্যাভ্যাসের প্রতিই যে তিনি শ্রদ্ধাশীল, তা বোঝাতেই এই মন্তব্য মমতার।
শুধু মিছিল থেকে নয়, বক্তৃতা থেকেও বার বার মমতা বুঝিয়ে দিতে চাইলেন তিনি সকলকে নিয়ে চলতেই পছন্দ করেন। মমতা মনে করিয়ে দেন, বাংলার শ্রমিকেরা যেমন ভিন্রাজ্যে কাজ করতে যান, তেমনই অন্য রাজ্য থেকেও অনেকে কাজ করতে আসেন বাংলায়। মমতার কথায়, ভিন্রাজ্য থেকে বাংলায় কাজে আসা শ্রমিকের সংখ্যা দেড় কোটিরও বেশি। তৃণমূলনেত্রী বলেন, “আমরা তাঁদের সঙ্গে কখনও এমন (বিজেপিশাসিত রাজ্যে বাঙালির প্রতি যে আচরণের অভিযোগ উঠছে) করি না। আমরা ইজ্জত দিই, আর আপনারা (কেন্দ্র) বেইজ্জত করেন।” ধর্ম দেখে দেখে বাঙালিদের হেনস্থা করা হচ্ছে, এমন অভিযোগও তোলেন মমতা।
বাঙালির উপর অত্যাচার যে রাজ্য সরকার এবং রাজ্যের শাসকদল কোনও ভাবেই বরদাস্ত করবে না, তা-ও বুঝিয়ে দেন মমতা। তিনি বলেন, “আমি বাংলায় বেশি করে কথা বলব। ক্ষমতা থাকলে আমাকে ডিটেনশন ক্যাম্পে আগে রাখো।” মমতা আরও বলেন, “আমি বাংলায় কাজ করি। বাংলার লোকে আমাকে বেছে নিয়েছেন। আমাকে বাংলায় কাজ করতে দিন। বাংলায় সমস্যা করলে আমি গোটা ভারতে ঘুরব। আমাকে আপনারা আটকে রাখতে পারবেন না। আমি দেখব কতগুলি ডিটেনশন ক্যাম্পে আমাকে নিয়ে যেতে পারেন। সেখানে গিয়েও আমি বাংলাতেই কথা বলব। বাংলার লোকেদের ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখলে বাংলার মানুষও বিজেপিকে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক ভাবে ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখবে।”
কোথাও বাঙালিদের উপর অত্যাচার হলে বাংলার পাশাপাশি সেখানে গিয়েও প্রতিবাদ হবে, সে কথাও জানিয়ে দেন মমতা। দিল্লিতে হেনস্থার শিকার হওয়া বাঙালিদের পাশে তৃণমূলের প্রতিনিধিদলের দাঁড়ানো এবং ছত্তীসগঢ়ের বাঙালি পরিবারদের কাছে মহুয়া মৈত্রকে পাঠানোর কথাও উল্লেখ করেন মমতা। তিনি বলেন, “সতর্কবার্তা দিয়ে গেলাম। মারবও না, কাটবও না, আপনাদের মতো ভাষা বিকৃতও করব না। যে ভাষায় আপনারা কথা বলেন, সেই ভাষায় আমরা কথা বলি না। তাই পরিষ্কার বলি, যদি না থামেন, তবে আগামী দিনে আপনাদের থামতে কী করা দরকার, সেটা বুঝে নেবেন। আমরা আহত হয়েছি। আমরা আহত হলেও সুসংহত। এর জবাব আমরা দেবই দেব।”