‘ব্যাক বেঞ্চার’ নয়, শান্তিনিকেতনে কবির শতবর্ষ প্রাচীন ভাবনা আগামীর ক্লাসরুমে
বর্তমান | ১৮ জুলাই ২০২৫
ইন্দ্রজিৎ রায়, বোলপুর: ‘নো ব্যাক-বেঞ্চার্স’। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই মুহূর্তে অন্যতম ট্রেন্ডিং। একটি মালয়ালম ছবি, ক্লাসরুমের আমূল বদলে উদ্যোগী কেরল এবং তারপর গোটা দেশেই শিক্ষানীতি নিয়ে নতুন করে ভাবনা। সমাজের আনাচে কানাচে এখন একটাই প্রশ্ন—এই কৃতিত্বের দাবিদার কে? একটি সিনেমা? নাকি দক্ষিণের একটি রাজ্য? তার থেকেও বড় প্রশ্ন, বাংলার কাছে কি সত্যিই এই ভাবনা নতুন? শতবর্ষ আগে ফিরে গেলে একটি ছবি ভেসে উঠবে চোখের সামনে... প্রকৃতির মাঝে গোল হয়ে বসে পড়ুয়ারা। আর তাদের মাঝে শিক্ষক। সেই শিক্ষক হয়তো কখনও ক্লাসরুমে বসেননি। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থা ঠিক কেমন হওয়া উচিত, তাঁর থেকে ভালো আর কেউ বোঝেনি। ১২৪ বছর ধরে সেই প্রমাণ বহন করে চলেছে বিশ্বভারতী। তার মাঝের পাঠভবন। আর সেই শিক্ষক? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
প্রাচীন বৈদিক যুগের তপোবনের শিক্ষা ব্যবস্থা শান্তিনিকেতনে ফিরিয়ে এনেছিলেন বিশ্বকবি। প্রকৃতির কোলে মুক্ত শিক্ষা—এই ছিল তাঁর ভাবনা। কবি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষা হবে আনন্দময়, শিশুর মনন ও অনুভূতির বিকাশে সহায়ক। সেই ভাবনা থেকেই ১৯০১ সালের ২২ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রহ্মচর্যাশ্রম বা পাঠভবন। এমন একটি ক্লাসরুম... যেখানে নেই চার দেওয়ালের বাঁধন। নেই সামনে বা পিছনের বেঞ্চের বিভাজনও। ছাত্রছাত্রীরা সেখানে গাছের ছায়ায় গোল হয়ে বসে পড়াশোনা করে। শেখে। এই ‘শিক্ষানীতি’ বিশ্বের নানা প্রান্তরেই পরিচিত। শুধু ভিন রাজ্য নয়, ভিন দেশ থেকেও পড়ুয়ারা আসেন এই ‘ক্লাসরুমে’র টানে। কিন্তু তারপরও বিশ্বভারতী ট্রেন্ডিং নয়। রবি ঠাকুরও নন। বরং ট্রেন্ডিং ‘স্থানার্থী শ্রীকুট্টন’। সেই মালয়ালম ছবি। ক্লাস সেভেনের ছাত্র শ্রীকুট্টনকে ঘিরে কাহিনির সূত্রপাত। সব পড়ুয়াকে সমান গুরুত্ব—এই ছিল তার লক্ষ্য। সে তুলে দিতে বলে ‘ব্যাক বেঞ্চ’। অর্ধবৃত্তাকারে বসার প্রস্তাব দেয়। সেই ‘অনুপ্রেরণা’তেই কেরলের পরিবহণমন্ত্রী তথা অভিনেতা কে বি গণেশকুমারের উদ্যোগে সে রাজ্যেরই কোল্লামের দু’টি স্কুলে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয় এই বসার রীতি। তারপর ছড়িয়ে পড়ে ধাপে ধাপে। কেরল, তামিলনাড়ু, এমনকী বাংলারও কিছু স্কুলে শুরু হয় ‘নো ব্যাক-বেঞ্চার্স’ নীতি। শিক্ষার পরিবেশে যেন কেউ পিছিয়ে না পড়ে। সমান গুরুত্ব। সবাইকে। আর এটাই যে কার্যকর করে গিয়েছেন ‘গুরুদেব’। শতবর্ষ আগে। পাঠভবনের অধ্যক্ষা বোধিরূপা সিনহা বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের আদর্শ মেনে পাঠভবনে পরীক্ষা তালিকা অ্যালফাবেটিক্যাল অর্ডারে প্রকাশিত হয়। কারণ, এখানে নম্বর দিয়ে মেধার বিচার হয় না। এছাড়া আলাদা করে কাউকে বিশেষভাবে পুরস্কৃতও করা হয় না। সবাই এখানে কিছু না কিছুতে পারদর্শী... এটাই আমরা বিশ্বাস করি। তাই কাউকেই ব্যাক-বেঞ্চার বলে মনে করি না।’
পাঠভবনের প্রাক্তনীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করছেন তাদের খোলা আকাশের নীচে গোল হয়ে বসা ক্লাসের ছবি। অনেকেই বলছেন, বর্তমানের ‘নো ব্যাক-বেঞ্চার্স’ উদ্যোগ আসলে রবীন্দ্রনাথের সেই যুগান্তকারী শিক্ষাভাবনারই আধুনিক প্রতিচ্ছবি। পাঠভবনের প্রাক্তনী, পরবর্তীকালে অধ্যক্ষ, ঠাকুর পরিবারের সদস্য সুপ্রিয় ঠাকুর বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের এই দর্শন বুঝতে সবার অনেক দেরি হয়ে গেল।’