সম্প্রতি শিরোনামে উঠে এসেছে এই দু’টি নাম। রাধিকাকে গুলি করে হত্যা করে তাঁর বাবা, সাধনার ক্ষেত্রেও বাবার হাতে বেধড়ক মারধরের পরে তার মৃত্যু হয়। এই নামগুলি কি ব্যতিক্রম? বিভিন্ন সমীক্ষা, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির অভিজ্ঞতা তেমনটা বলছে না। এই নাম দু’টি আসলে একটি দীর্ঘ তালিকার অংশ, যাদের উপরে অত্যাচার চলে আসছেবছরের পর বছর। এ ক্ষেত্রে শুধু অত্যাচার চরমে পৌঁছেছে বলেই তা প্রকাশ্যে এসেছে।
বাড়ি মানেই নিরাপদ— এই ধারণা অনেকের কাছে স্বাভাবিক। আবার ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে ‘গার্হস্থ্য হিংসা’র কথা উঠলে দৃষ্টি চলে যায় স্বামীর পরিবার বা বৈবাহিক সম্পর্কের দিকে। কিন্তু উপেক্ষিত থাকে একটি জরুরি প্রশ্ন— নারীর নিজের জন্মপরিবার কি আদৌ নিরাপদ? একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার করা ‘জন্মপরিবার: নারীর উপরে গার্হস্থ্য হিংসার এক উপেক্ষিত ক্ষেত্র’ শীর্ষক সমীক্ষা সেই প্রশ্নই সামনে এনেছে। সমীক্ষার বাস্তব বলছে, জন্মপরিবারে নারী-নির্যাতন সমাজে প্রায় অদৃশ্য।কারণ, এই নির্যাতনের শিকড় রয়েছে সমাজের গভীরে, আত্মীয়তার মোড়কে ঢাকা।
মূল সমীক্ষক, ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা স্বয়মের প্রতিষ্ঠাতা অনুরাধা কপূর জানাচ্ছেন, এমন হিংসার ঘটনা মূলত প্রকাশ পায় লিঙ্গভেদ, যৌন হেনস্থা ও ধর্ষণ, মারধর, খেতে না দেওয়া, পড়াশোনা-চাকরি করতে না দেওয়া, মানসিক নির্যাতন, সঙ্গী নির্বাচন করতে না দেওয়া, জোর করে বিয়ে দেওয়া, চলাফেরা-পোশাকে বিধিনিষেধ, সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার মতো ঘটনার মধ্যে দিয়ে। মা, বাবা, ভাই-বোন বা আত্মীয়স্বজনেরাই থাকেন এর পিছনে। তা সব সময়ে চিহ্নিত করা যায় না; কারণ, এর অনেক কিছুই সমাজের চোখে নিতান্ত ‘স্বাভাবিক’।
এই সামাজিক কাঠামোয় শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত নারী, বা লিঙ্গ ও অপ্রচলিত যৌন পরিচয়ধারীরা হিংসার শিকার হন আরও বেশি। শুধু অত্যাচারই নয়, বরং বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া, ‘সংশোধন’-এর নামে নির্যাতন, এমনকি, খুনও করা হয় তাঁদের। অনুরাধা জানাচ্ছেন, ওই সমীক্ষার উদ্দেশ্য, নিজগৃহে এই হিংসার সব ধরনগুলিকে একটিই পরিভাষায় সংজ্ঞায়িত করা— নেটাল ফ্যামিলি ভায়োলেন্স বা জন্মপরিবারে ঘটিত হিংসা, যাতে তার গভীরতা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভিত্তিগুলি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আইনি পথে হাঁটার রাস্তাও সুগম হয়।
বৃহস্পতিবার এ নিয়ে আলোচনায় উঠে এল, এই ধরনের হিংসার ক্ষেত্রে আইনি অভিযোগ জানানো হয় খুবই কম। এমনকি, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোতেও জন্মপরিবারে হিংসার পরিসংখ্যান মেলে না। অভিযোগ জানাতে অনীহার কারণ হিসাবে উঠে এসেছে আশ্রয়চ্যুত হওয়ার ভয়, পরিবারের বিরুদ্ধে যেতে দ্বিধা এবং সর্বোপরি, অভিযোগ জানিয়েও অবিশ্বাসের মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা।
ওই সংস্থার কর্মীদের অভিজ্ঞতা, ‘পারিবারিক বিষয়ে’ হস্তক্ষেপ করতে অনীহা দেখা যায় পুলিশ বা অন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে। বিশেষত, অভিযুক্ত যদি মা-বাবা হন, তা হলে উল্টে অভিযোগকারিণীকেই বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তাঁরা যা করছেন, ভালর জন্যই করছেন। এই ভাবেই অস্বীকার করা বা ভুল প্রমাণ করার চেষ্টার মাধ্যমে চাপা দেওয়া হয় মেয়েদের হিংসার অভিজ্ঞতা। চাপা দেওয়া হয় তাঁদের ব্যক্তিপরিচয়, আত্মমর্যাদাবোধের ক্ষয়, মানসিক স্থিতিহীনতা, বিশ্বাসভঙ্গের যন্ত্রণা, আত্মহত্যার চিন্তা ও চেষ্টা। উল্টো দিকে, স্বাভাবিক তকমা দেওয়া হয় হিংসার ঘটনাকে, যাতে বহু নির্যাতিতাও বুঝতে পারেন না, যা হচ্ছে তা আসলে অপরাধ।
যে ঘটনা আসলে একটি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, তা এড়িয়ে যাওয়ার এই প্রচেষ্টা রোখা যাবে কোন পথে? উপস্থিত সমাজকর্মীদের মত, নিরন্তর সচেতনতার প্রচার ও নীতিগত দাবি পূরণে সক্রিয়তাই একমাত্র পথ। অনুরাধা বলেন, ‘‘জন্মপরিবারে হিংসার প্রতিটি ধরন নিয়েই আইন রয়েছে। তাই নতুন আইন নয়, দরকার আইনের উপযুক্ত প্রয়োগ। দরকার রাষ্ট্রের সহযোগিতা।’’