• ২১ জুলাইয়ের পর জ্যোতিবাবুর বাড়িতে নৈশভোজে গিয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ২১ জুলাই ২০২৫
  • ফিরহাদ হাকিমকলকতার মেয়র তথা রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী

    যারা সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, তারা ২১ জুলাইয়ের তাৎপর্য খুব ভালো করেই জানে। মহাকরণ অভিযান প্রাথমিকভাবে ২১ তারিখ হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু তদানীন্তন রাজ্যপাল সৈয়দ নুরুল হাসান মারা যাওয়ায় সেটা পিছিয়ে ২১ জুলাই করা হয়। আমরা তখন কংগ্রেসে ছিলাম। পুলিশের কাছ থেকে মাইকের, স্টেজের পারমিশন চাইছিলাম। কিন্তু পুলিশ পারমিশন দিচ্ছিল না। ২১ জুলাই হাজরা মোড় থেকে জমায়েত করে আমরা মেয়ো রোডের দিকে এগোচ্ছিলাম। আমি তখন কংগ্রেসের এক সাধারণ কর্মী। যে লরিটার উপর স্টেজ হয়েছিল, হঠাৎ দেখলাম পুলিশ সেই লরিতে উঠে গিয়ে মাইকের তার ছিঁড়ে দিল। বিনা প্ররোচনায় শুরু হলো লাঠিচার্জ, ছোঁড়া হলো টিয়ার গ্যাস।

    মদন মিত্র ও পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায়রা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। শুনলাম, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরেও আক্রমণ হয়েছে। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে সৌগত রায় আহত হয়েছেন। আমরা তখন নেতৃত্বহীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ আকাশবাণীর পাশ থেকে একদল পুলিশকে ছুটে আসতে দেখলাম। একজন অফিসার বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও, ওরা নিজেদের অফিসারকেই ঠেলে ফেলে দিল। গালিগালাজ করতে করতে ওরা একেবারে আমাদের মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। তারপরই শুরু করল ফায়ারিং।

    চারদিক ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে, টিয়ার গ্যাসে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বুঝতে পারছিলাম না কী হচ্ছে। হঠাৎ দেখলাম, দু’তিনটে ছেলে পড়ে গেল। তখন আমাকে কেউ একজন টেনে স্পোর্টস জার্নালিস্ট ক্লাবে ঢুকিয়ে দিল। গামছা জলে ভিজিয়ে সেটা চোখে দিতে দিতে দেখলাম, সেই লরির নিচে একটা ছেলে লুকিয়ে আছে। পুলিশ লরির কাছে গিয়ে ছেলেটাকে গুলি করে দিল।
    পরিস্থিতি একটু শান্ত হতেই সংবাদমাধ্যমের কয়েকটি গাড়ি এল। আহত দু’জনকে গাড়িতে তুলে নিয়ে আমরা পিজি হাসপাতালের দিকে রওনা দিলাম। বুঝতেই পারছিলাম না কে বাঁচবে, কে বাঁচেনি। একের পর এক দেহ আসতে থাকল। পরে জানতে পারলাম ১৩ জন শহীদ হয়েছেন, আহত ১০০-রও বেশি। কেউ চোখ হারিয়েছেন, কারও পা নেই, কারও হাত নেই। তখনই বুঝেছিলাম বর্বরতা কাকে বলে। সেই রাতে পিজি হাসপাতালের এমার্জেন্সির সামনে দাঁড়িয়ে, ছেলেদের নিয়ে ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প করেছিলাম।

    আরো বেশি লজ্জা লেগেছিল পরদিন। তৎকালীন কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এস.বি. চৌহান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখতে কলকাতায় এসেছিলেন। আহতদের দেখতে তিনি পিজিতেও যান। তিনি তখন জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। পুলিশ মারফত খবর এল, জ্যোতিবাবু রাইটার্সে আসবেন না, বরং সল্টলেকে তাঁর বাড়িতে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন তিনি।
    আমি নিজে গিয়ে চৌহানজির পা ধরে বলেছিলাম, ‘আমাদের ছেলেদের যারা মারল, তাদের বাড়িতে দয়া করে যাবেন না। ওটা বিশ্বাসঘাতকতা হবে।’ উনি বললেন যাবেন না। কিন্তু পরদিন সংবাদমাধ্যমে দেখলাম, রাতে জ্যোতিবাবুর বাড়িতে নৈশভোজ সেরে তিনি দিল্লি ফিরে গেছেন। সেইদিন বুঝেছিলাম, কংগ্রেসের সঙ্গে থেকে সিপিএমকে সরানো সম্ভব নয়। কারণ কংগ্রেস আসলে সিপিএমের দালাল। আমরা গুলি খাই, মার খাই, ওদের কিছুই যায় আসে না। দিল্লিতে সিট বাঁচিয়ে রাখার জন্যই ওরা আমাদের ব্যবহার করছে। নিজেদের মধ্যে লড়াই, অপমান, রেষারেষি ও গুণ্ডা প্রদর্শনী চলতো কংগ্রেসে। ধন্যবাদ জানাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে, কারণ তিনিই তখন বলেছিলেন, আমাদের আসল লড়াই কংগ্রেসের মধ্যে নয়, সিপিএমের বিরুদ্ধে।

    সিপিএম তখন শক্তিশালী ছিল। কিন্তু বর্তমানে টিভিতে এসে মাঝেমাঝে দু-চারটে কথা বলা ছাড়া ওদের আর কিছুই নেই। নতুন বিধায়করা এসে আমায় জিজ্ঞেস করেন, ‘দাদা, সিপিএম কোথায় বসে?’ আমি বলি, ‘বসে না, বসতো।’ এখন কংগ্রেসও প্রায় জিরো।

    কিন্তু এখন যে দলের সঙ্গে আমাদের লড়াই, সেই বিজেপি আরও ভয়ঙ্কর। সিপিএম আমাদের গুলি করেছিল, মারধর করেছিল। কিন্তু বিজেপি আমাদের ব্যক্তিগত আক্রমণ করছে। দেশের ঐক্য, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ভেঙে তছনছ করে দেওয়ার চেষ্টা করছে।

    কাশ্মীরে ধর্ম জিজ্ঞেস করে গুলি চলল। কারা করল এটা, কেন করল? এতে রাজনৈতিক সুবিধা কার হবে? সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার বাড়বে, দেশজুড়ে উস্কানি ছড়াবে। এই অরাজকতার জন্যই ধর্ম দেখে গুলি চালিয়েছে জঙ্গিরা। সবটাই বিজেপির সুবিধার জন্য।

    আমরা বাঙালি। আমাদের একটাই পরিচয়, আমরা ভারতবাসী। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। আমরা বাংলায় গান গাই, বাংলা কবিতা পড়ি, বাংলায় স্বপ্ন দেখি। কিন্তু আজ বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের ‘বাংলাদেশি’ বলে অপমান করা হচ্ছে। একজন ভারতীয় নাগরিক গুজরাটে যাবে, উত্তরপ্রদেশে যাবে, এটাই তো স্বাধীনতা। কিন্তু শুধুমাত্র বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য অনেকের পানীয় জল, বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের কলকাতায় প্রচুর ভিনরাজ্যের মানুষ থাকেন। ভবানীপুরে অসংখ্য গুজরাটি ভাইয়েরা থাকেন। বাংলার কারখানায় বিহারী, ওড়িয়া ভাইয়েরা কাজ করেন। দোকানে-দোকানে ওড়িয়া ভাইয়েরা পুজো করেন, অনেকে রান্না করেন। আমরা কখনও তাঁদের বহিরাগত ভাবিনি। তাঁরা আমাদেরই অংশ। তাহলে বাঙালিরা বাংলায় কথা বললে এত অত্যাচার কেন? বাংলার সন্তানদের বাংলাদেশে পাঠানোর কথা কেন বলবে বিজেপি, কেন আমাদের ভাষাকে অপমান করা হবে?

    রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, নেতাজিরা বাঙালি ছিলেন। এই বাংলা আমাদের গর্ব। এই বাংলাকে অপমান করছে বিজেপির ডবল ইঞ্জিন সরকার। তাই, যতদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আছেন, আমরা বারবার রাস্তায় নামব, প্রতিবাদ করব। বাংলার ভাষা, সংস্কৃতি, মানুষ ও ঐক্যের পক্ষে লড়াই করব।

    অনুলিখন: শোভন মণ্ডল
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)