অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জুড়ি মেলা ভার। এ কাজে তিনি নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন সারাজীবন। কোনওদিন তার ব্যতিক্রম হয়নি। আগামীতেও হবে না। সাধারণ মানুষের জন্য তাঁর এই লড়াই মমতাকে মহীরূহে পরিণত করেছে। তাঁর এই আপসহীন সংগ্রাম মানুষকে সঙ্গে নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সিপিএমের মতো সাংগঠনিক শক্তিকে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা থেকে মুছে ফেলা নেহাতই সোজা কাজ ছিল না। সেই কাজটি তিনি করে দেখিয়েছেন নিপুণভাবে। মানুষের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা পশ্চিমবঙ্গ ও বামেরা সমার্থক। এখানে কোনও পরিবর্তন আসা সম্ভব নয়। কারণ বামেদের সরানোর মতো বিশ্বাসযোগ্য মুখ এবং বিকল্প শক্তির অভাব। ঠিক সেই সময় নিখাদ বাম বিরোধিতাকে মূলধন করে অবতীর্ণ হন মমতা। আর এখানেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্যারিশ্মা।
সাধারণ মানুষের কাছে নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেষ্টার কোনও ত্রুটি ছিল না। কারণ যেসব বিষয়গুলিকে সামনে রেখে তিনি পথে নেমেছিলেন, এখনও পথে নামছেন, তা আমজনতার দৈনন্দিন সমস্যা। ফলে মমতার প্রতি অগণিত সাধারণ মানুষের ভালোবাসা, স্নেহ, মমত্ববোধ কোথাও একসূত্রে বাঁধা পড়েছে। তাঁর আন্দোলনের প্রতি আমজনতার এই বিশ্বাস জাতীয় রাজনীতিতে নিঃসন্দেহে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। মানুষ বিপদে পড়লে নিজেকে স্থির রাখতে পারেন না মমতা। তিনি যে পদেই থাকুন না কেন, তাঁর আন্দোলনের রূপরেখা এবং এবং পথে নেমে প্রতিবাদ দেখে মনে হয় তিনিই সরকার, তিনিই বিরোধী।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে নয়, মানুষের দুয়ারে গিয়ে তাঁদের দুর্দশা মেটানোকে তিনি জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবে তাঁর মতো মানবদরদি মুখ্যমন্ত্রী বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিঃসন্দেহে বিরল। ইচ্ছে করলে পারতেন বিলাসবহুল জীবনযাপন করতে। কিন্তু সে পথে তিনি পা বাড়াননি। আটপৌরে জীবনেই অভ্যস্থ দেশের অন্যতম দরিদ্রতম মুখ্যমন্ত্রী।
২০১১-তে রাজ্যের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর ব্যস্ততা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে। সে কারণে তাঁর ফুরসত নেওয়ার সময় নেই। কারণ ‘সময় তো নেই, কথা দেওয়া আছে আগে। এখনও যে পথ আছে বাকি। কেন্দ্রীয় বঞ্চনা সত্ত্বেও রাজ্যের সীমিত আর্থিক ক্ষমতার মধ্যে মমতা চেষ্টা করছেন জঙ্গলমহলের দিন আনা দিন খাওয়া মানুষজন, ঘাটালের বানভাসি মানুষদের দুর্দশা মিটিয়ে তাঁদের মুখে হাসি ফোটাতে। কারণ এই মানুষদের বুক চিতিয়ে লড়াই মমতাকে পৌঁছে দিয়েছে মহাকরণ থেকে নবান্নে। সাধারণ মানুষ উপলব্ধি করেছেন তাঁদেরই একজন প্রতিনিধি এমন জায়গায় রয়েছেন, যেখানে আমজনতার দুঃখ-দুর্দশা অনুভব করা যায় না, মানবিক মুখ নিয়ে তাঁদের চোখের জল মুছে ফেলা যায়। সে কারণে গ্রামবাংলার অগণিত সাধারণ মানুষ নিশ্চিত অনুভব করেন তাঁদের প্রিয় দিদিকে মুখ্যমন্ত্রী পেয়ে।
একটানা তিনবার রাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার অনন্য রেকর্ড তাঁর ঝুলিতে রয়েছে। চতুর্থবারের জন্য তাঁর মুখ্যমন্ত্রী হওয়াটা অনেকটা সময়ের অপেক্ষা। তবে আত্মতুষ্টিতে ভুগতে রাজি নন তৃণমূল সুপ্রিমো। তিনি জানেন, এই রাজ্যকে ঘিরে বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্র তৈরি করা হচ্ছে। সে কারণে সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে তিনি শ্রেয় মনে করে পথে নামছেন। ভাষাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশী তকমা দেগে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর আন্দোলন যে উচ্চগ্রামে পৌছবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সে কারণেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আন্দোলনের এক নাম। যখন যেখানে কোনও অন্যায়, অত্যাচার কিংবা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস সাধারণ মানুষের উপর নেমে এসেছে, তখন সেখানে আপসহীন লড়াইয়ের মূর্ত প্রতীক হয়ে মাঠে নেমেছেন। সে কারণে এই মমতাকে রোখা এত সহজ নয়। মোদী-অমিত শাহরা এই বাংলাকে ঘিরে যে ধরনের কৌশল তৈরি করুক না কেন, সেই চক্রান্তের জাল ভেদ করাটা মমতার কাছে নতুন কোনও ব্যাপার নয়। কারণ তাঁর উঠে আসা এবং পরবর্তী সময়ে দ্রুতগতিতে তাঁর রাজনৈতিক উত্থান প্রান্তিক মানুষদের সঙ্গে নিয়ে। আমজনতার দুঃখদুর্দশার সঙ্গে মমতার সম্যক ধারণা রয়েছে। তাই ভোটাধিকার ও নাগরিকত্বের রাজনীতিকে সামনে রেখে বিজেপি যখন এক অন্য ধরনের তাস খেলছে, তা মমতা সহজেই ধরে ফেলেছেন। সে কারণে তিনি পথে নেমেছেন। প্রতিবাদ করছেন। তিনি জানেন ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে কী করে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা যায়।
১৯৯৩ সালের ২১ জুলাইয়ের সঙ্গে ২০২৬ সালের ২১ জুলাইয়ের মধ্যে অনেক অমিল থাকলেও সবচেয়ে বড় মিল সেদিন মমতা পথে নেমেছিলেন গণতান্ত্রিক অধিকারকে রক্ষা করতে। এবারেও তার ব্যতিক্রম হবে না।
এবারেও ২১ জুলাইকে ঘিরে যে ধরনের উন্মাদনা তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। কারণ মমতা এখন কোনও ব্যক্তি নন, তিনি রীতিমতো প্রতিষ্ঠান। তাঁর দল তৃণমূল এখন বটবৃক্ষে পরিণত। সে বটবৃক্ষের তলায় আশ্রয় নিয়ে শুধু এ রাজ্যেরই নয়, ভিনরাজ্যেরও অনেকই এখন জনপ্রতিনিধি হয়েছেন। দেশের সর্বত্র মমতার জনপ্রিয়তা আগের থেকে অনেকখানি বেড়েছে। কেন্দ্রে সরকার গড়ার ক্ষেত্রে তৃণমূল কী চাইছে, জানতে চায় মানুষজন। একটি আঞ্চলিক দলকে ঘিরে সর্বোপরি মমতাকে ঘিরে মানুষের প্রত্যাশা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর অনেকে বদলে গেলেও নিজেকে বদলাননি মমতা। তিনি আরও বেশি করে একাত্ম হয়েছেন আমজনতার সঙ্গে। কারণ মমতার উত্থান গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সংগ্রামের সিঁড়ি বেয়ে। সাফল্যের সিঁড়িতে পৌঁছে অনেকে হারিয়ে যান। জনগণের সঙ্গে তৈরি হয় সীমাহীন দূরত্ব। কিন্তু মমতার ক্ষেত্রে তা কখনও সম্ভব নয়। একথা কেউ বুঝুক বা না বুঝুক বামেরা হাড়ে হাড়ে বুঝেছে। এতদিন বামেরা ভাবত সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করার একচ্ছত্র অধিকার তাদেরই রয়েছে। কিন্তু সে বদ্ধমূল ধারণা আজ আর বামেদের মধ্যে আছে বলে মনে হয় না। ফলে বামেদের আন্দোলনের পালে হাওয়া কেড়ে নিয়েছেন মমতা। অনেক আলাপ-আলোচনার মধ্যে বামেরা বুঝতে পারছে না ঠিক কোন কৌশল অবলম্বন করলে তাদের ভোটব্যাঙ্কে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে সুদিন আসবে। সে কারণে ১৯৯৩ সালে ২১ জুলাইয়ের আন্দোলনের তাৎপর্য যে সুদূরপ্রসারী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ২১-এর আন্দোলনে সলতে পাকানোর কাজ শুরু হয়েছিল।
পরবর্তী ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে জমিরক্ষার আন্দোলন জাতীয় রাজনীতিতে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। জঙ্গলমহল মাও মুক্ত করার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসনের অবদান প্রশংসনীয়। এর পাশাপাশি পাহাড়ের শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য মমতা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। মমতা যা কিছুই করেছেন, গণতান্ত্রিক ভাবেই করেছেন। কিন্তু বর্তমানে সেই গণতন্ত্র এবং সংবিধানকে অবহেলা করে ক্ষমতা দখল করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে বিজেপি। মানুষের রায়ে নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দিতে চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি গেরুয়া শিবির। এখানেই মমতার লড়াই। কাজটা নিঃসন্দেহে কঠিন। কেজরিওয়াল পারেননি। মমতা কি পারবেন?