• ‘শহিদ স্মৃতিতর্পণ ও শপথ নেওয়ার দিন একুশে জুলাই’
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ২১ জুলাই ২০২৫
  • শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, মন্ত্রী, কৃষি ও পরিষদীয় দপ্তর

    ২১ জুলাই ১৯৯৩ স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে সংগঠিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক কলঙ্ক জনক দিন। সেদিন মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে নিরস্ত্র যুব কংগ্রেস কর্মীদের ওপর নির্মম ভাবে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়েছিল ১৩ জন যুবককে এবং ২০৬ জন আহত হয়েছিল।

    ১৯৭৭ সালের পর যতগুলি নির্বাচন হয়েছে প্রায় সব নির্বাচনেই মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে চলেছে বল্গাহীন অত্যাচার। বাংলার অত্যাচারিত কর্মীরা দিল্লির কংগ্রেস নেতাদের কাছে সাহায্য ও সহযোগিতা চেয়ে ব্যর্থ হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর দিল্লির কাছে কোনও করুণা ভিক্ষা নয়, লড়াই করেই অধিকার ছিনিয়ে নিতে হবে। একের পর এক নির্বাচনে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে যেভাবে কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখল করছে তার বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আওয়াজ তুললেন, ‘No identity card no vote’ অর্থাৎ প্রকৃত ভোটার ভোট দিক। ভুতুড়ে ভোটারদের দিয়ে ভোট করে জিততে দেব না। নিরপেক্ষ প্রশাসনের ও ‘No identity card no vote’ এর দাবিতে মহাকরণ আবরোধের ডাক দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২১ জুলাই ১৯৯৩ সাল। পাঁচটি জায়গায় জমায়েত করে মহাকরণ অবরোধের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। মানুষকে সংঘবদ্ধ করে ধর্মতলায় নিয়ে আসার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আমরা অনেক পথসভা ও কর্মিসভা করেছি। বিপুল সাড়া পাওয়া গিয়েছিল সারা বাংলা থেকে। যদিও মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ও প্রশাসন এই অবরোধ বানচাল করে দেওয়ার জন্য কোনও ত্রুটি রাখেনি এবং ব্লু-প্রিন্টও তৈরি করেছিল। স্বৈরাচারী সরকারের সমস্ত চক্রান্ত জানার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশাসনকে জানিয়েছিলেন যে গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণভাবেই সভা হবে কিন্তু যাদের রক্তে হিংস্রতা, যাদের নীতিতে বিরোধী শত্রু মানেই শ্রেণিশত্রু তাদের কাছে অহিংস আন্দোলনের বার্তায় কোনও প্রতিক্রিয়া হয়নি, যেটা আমরা বুঝতে পেরেছিলাম ২১ জুলাই।

    ২১ জুলাই ১৯৯৩ সালের কথা লিখতে বসে মনে হচ্ছিল কমিউনিস্টদের চরিত্র পাল্টাবে কেমন করে। কমিউনিস্টরা বিরোধী শক্তিকে দমন করার জন্য কতটা নির্মম এবং হিংস্র হতে পারে তার নজির ২১ জুলাই। স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষে কোনও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এতগুলি (১৩ জন) মানুষ প্রাণ হারায়নি, এতজন (২০৬ জন) আহত হননি যা পশ্চিমবঙ্গে হয়েছে। বিশ্বের সর্বত্র যেখানে কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখল করেছে সেখানেই যাকে মনে হয়েছে কমিউনিস্ট বিরোধী তাদের হত্যা করেছে অথবা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে’ বন্দি করে রেখেছে। নোবেল পুরস্কার জয়ী রুশ সাহিত্যিক আলেকজান্ডার সোলজেনৎসিন তাঁর ‘গুলাগ আর্কিপুলাগো’ বইয়ে কমিউনিস্ট অত্যাচারের কথা লিখেছেন।

    কমিউনিস্টরা কত নৃশংস হতে পারে তার নজির এই বাংলার মাটিতেই আছে। পৃথিবীর অনেক অত্যাচারী শাসকের কথা আমরা জানি। যেমন হিটলার, মুসোলিনি, পলপট, ইদি আমিন কিন্তু অত্যাচার ও বর্বরতায় সবার থেকে এগিয়ে তিনি কমিউনিস্ট শাসক স্টালিন যার অঙ্গুলিহেলনে রাশিয়ায় খুন হয়েছিল লক্ষ লক্ষ মানুষ। আজ রাশিয়ার মানুষ কমিউনিস্টদের ঘৃণা করে। একইভাবে বাংলার কমিউনিস্টদের ঘৃণা করে তাদের অত্যাচারের জন্য। আমরা ভুলিনি মরিচ ঝাঁপির বর্বর অত্যাচারের কথা। বাড়িতে আগুন লাগিয়ে, গুলি চালিয়ে খুন করেছিল ছিন্নমূল ওপার বাংলার মানুষদের। বিজন সেতু ঘটনায় বাংলার কৃষ্টি, সংস্কৃতি কলঙ্কিত হয়েছিল। ১৭ জন সন্ন্যাসীকে মেরে জীবন্ত জ্বালিয়ে ছাই করে দিয়েছিল। ছোট আঙারিয়া, বীরভূমের সুচপুর, সাঁইবাড়ী, কান্দুয়া, ঘোকসাডাঙা, বানতলা, ধানতলা, নন্দীগ্রাম, বজবজ, নেতাই, সিঙ্গুর-সহ অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী পশ্চিমবাংলার মানুষ। এই অত্যাচার বাংলার ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। বাংলা ও বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ভুলুণ্ঠিত হয়েছে।

    ২১ জুলাই ১৯৯৩ সালের ঘটনা কমিউনিস্টদের ঐতিহ্য বহন করেছে মাত্র, ওরা চেয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্তব্ধ করে দিতে কারণ বাংলার যে কোনও প্রান্তে যখনই সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার নেমে এসেছে সেখানেই নিজের জীবন বাজি রেখে পৌঁছে গিয়ে অত্যাচারিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ইতিহাস বলে কমিউনিস্টরা বিরোধীতা সহ্য করতে পারে না। সমগ্র বিশ্বেরমানুষ চিনের তিয়েন-আন-মেন স্কোয়ারের ঘটনা ভুলতে পারবে না। শুধু দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার জন্য অসংখ্য মানুষকে খুন করেছিল। যারা কোনওক্রমে পালিয়ে গিয়েছিল তারা আজও জেলে পচে মরছে। ২১ জুলাইয়ের ঘটনায় মর্মাহত হয়েছি কিন্তু বিস্মিত হইনি কারণ আমি কমিউনিস্টদের দেশে দেশে অত্যাচারের কাহিনি জানি।

    ২১ জুলাই ছিল প্রতিবাদের দিন। কিন্তু কোনও কর্মী পকেটে করে অথবা থলে ভরে ইট নিয়ে যায়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে হবে। মহাকরণকে ঘিরে পাঁচ জায়গায় অবরোধ করে দলীয় নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখবে। পুলিশ আগে থেকেই ফাঁদ পেতে রেখেছিল। মেয়ো রোডের মোড়ে কোনও মঞ্চ তৈরি করতে দেয়নি। ফলে হাজার হাজার কর্মীর মিছিল যত এগিয়েছে তত সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কর্মী চাপ সহ্য করতে না পেরে সামনের দিকে এগিয়েছে। কিন্তু পুলিশকে আক্রমণ করেনি। শুরুতেই মৃদু লাঠিচার্জ করার জন্য পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায় ম্যাটাডর থেকে নেমে এগিয়ে যান। পুলিশের সঙ্গে তর্কাতর্কি হতেই পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায় আহত হন ও হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। ১১-৩০ মিঃ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসেন এবং বক্তব্য রেখে কর্মীদের সংযত থাকার আবেদন জানান। তিনি পুলিশকেও সংযত থাকার জন্য আবেদন করে আমাকে শেষপর্যন্ত থেকে দায়িত্ব পালন করার কথা বলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই মদন মিত্র অসুস্থ বোধ করে চলে যান। সত্য বাপুলি এবং আমি লাগাতার বক্তব্য রাখি। জেলার নেতারাও বক্তব্য রাখেন। ১২-১২.৩০টা নাগাদ হঠাৎই পুলিশ লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে ছুড়তে এগোতে থাকে। কিছু কর্মী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় আর কিছু কর্মী সামনের দিকেই এগিয়ে যায়। এরপর পুলিশ বেপরোয়া গুলি চালাতে থাকে চোখের সামনে এক-একজন গুলি খেয়ে পড়ে যেতে থাকে। আমি বারবার আবেদন করি কিন্তু পুলিশ কোনও আবেদনেই কর্ণপাত না করে গুলি চালাতে থাকে। চারিদিকে শুধু আর্তনাদ আর জল জল করে চিৎকার। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেয়ো রোডের মোড়। আমি ম্যাটাডর চালককে ডানদিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলি। এই সময় সত্য বাপুলিও শরীর খারাপ লাগায় চলে যান। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে একাই মাইকে আবেদন করতে থাকি। এইসময় একটা কাঁদানে গ্যাসের শেল সরাসরি গায়ে লাগে। আমার প্রবল বমি হতে থাকে। আমাকে পাশেই প্রেস ক্লাবে টেবল টেনিস কোর্টে শুইয়ে মুখে জল দিয়ে ডাক্তারখানায় নিয়ে যায় সুপ্রিয়া, শ্রীমন্ত, গোপাল-সহ কয়েকজন। ডাক্তার ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। পরদিন জানতে পারি আমাদের ১৩ জন কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে এবং অসংখ্য কর্মী আহত যারা বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থা এতই গুরুতর যে তাঁকে হাসপাতালে, প্রথমে, পরে নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়েছে।

    এই ভয়ংকর, অমানবিক, বর্বর ও স্বৈরাচারী আক্রমণ ছিল পূর্ব পরিকল্পিত অর্থাৎ মানুষ খুনে কমিউনিস্টদের হাত একটুও কাঁপেনি। বাংলার ইতিহাস গর্বের ইতিহাস, বিদ্রোহের ইতিহাস, সংগ্রামের ইতিহাস।

    আজ প্রমাণিত যে অত্যাচার করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দমানো যায়নি। তাই ২০১১ সালের রৌদ্রকরোজ্জ্বল প্রভাতে মানুষ হিংস্র, অত্যাচারী, বর্বর ও স্বৈরাচারী শাসনের অবসান করেছে।

    ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই ছিল যে দাবিতে লড়াই আজ ৩২ বছর পেরিয়ে আমরা এক সুপরিকল্পিত চক্রান্তের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে অস্থিরতার জন্ম দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নের অভিমুখ পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করছে।

    অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, অনেকবার আক্রান্ত হয়ে, বহু গণ-আন্দোলনের পথে ধরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ বাংলার নেত্রী এবং ভারতের জনপ্রিয়তম মুখ্যমন্ত্রী যিনি একক প্রয়াসে বাংলাকে বিশ্ববাংলায় পরিণত করেছেন।

    যে কোনও মুল্যে সব চক্রান্ত রুখে দেওয়ার শপথ নেওয়ার দিন ২১ জুলাই। অশান্তির বিরুদ্ধে মমতার অস্ত্র শান্তি, অনুন্নয়নের বিরুদ্ধে উন্নয়ন।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)