• বাঙালি হেনস্থাই এই মুহূর্তের জ্বলন্ত ইস্যু
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ২১ জুলাই ২০২৫
  • সৈয়দ হাসমত জালাল

    সরকারি সূত্রেই জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গে ভারতের অন্যান্য রাজ্যের প্রায় দেড় কোটি মানুষ শুধুমাত্র কর্মসূত্রেই রয়েছেন। তাঁরা অত্যন্ত স্বচ্ছন্দে এবং নিরাপদে তাঁদের জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করছেন এ রাজ্যে। অথচ ভারতের অন্যান্য রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী মানুষেরা, বিশেষত পরিযায়ী শ্রমিকেরা ভয়ঙ্কর হেনস্থার মুখে পড়ছেন। সেখানে বাংলা ভাষায় কথা বললেই তাঁদের ‘বাংলাদেশি’ তকমা দিয়ে হাজতে বা জেলেও পাঠানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষেই বাংলার শ্রমিকেরা এই সঙ্কটে পড়ছেন। তবে বিশেষ করে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের আরও বেশি হেনস্থা করা হচ্ছে। এ এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। নিজের দেশেই বাঙালিদের বাংলাদেশের  নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দিয়ে আসা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে তাঁদের আধার কার্ড, ভোটার কার্ড বা অন্যান্য পরিচয়পত্র ওইসব রাজ্যের পুলিশ বা প্রশাসন ধর্তব্যের মধ্যেই আনছে না। ইদানিং প্রতিদিনই সংবাদপত্রে এই ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। এই ইস্যু নিয়ে সম্প্রতি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পথে নেমে মিছিলও করেছেন। বিরোধীদের মধ্যে বামপন্থী ও কংগ্রেস দলও এই ইস্যুতেই পথে নেমেছে। তবে প্রতিবাদ আরও যতখানি তীব্র হওয়া প্রয়োজন, তা এখনও অন্যদলগুলির মধ্যে চোখে পড়ছে না।

    অন্যদিকে, এ রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি ক্রমাগত সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়ঙ্কর অসত্য কিছু কথা প্রচার করে চলেছে। তাঁরা এই প্রচারের মধ্যে দিয়ে সাধারণ মানুষকে বোঝাতে চাইছেন, পশ্চিমবঙ্গ ক্রমশ অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি নাগরিকে ভরে যাচ্ছে। এমনকি রোহিঙ্গারাও এই রাজ্যে এসে বসতি তৈরি করেছে। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা একজন কট্টর বিজেপি হিসেবে এই অসত্যের আগুনে ক্রমাগত ঘি ঢেলে চলেছেন। সব দেশেই অনুপ্রবেশের ঘটনা দেখা যায়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ ও অসমে যেভাবে বাংলাভাষী বাংলাদেশিদের অনুপ্রবেশ ঘটছে বলে চিল-চিৎকার করা হচ্ছে, তার বাস্তব ভিত্তি আদৌ তা নয়। যদি তার কিছু অংশও সত্য হয়, তাহলে তা কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতা বলেই ধরে নিতে হবে। অসমে তো বিজেপি সরকার এবং সেখানে সীমান্ত পাহারা দেয় বিএসএফ, যা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে। তাহলে অসমে কীভাবে, হিমন্ত কথিত, এত অনুপ্রবেশ ঘটছে? আসলে বিষয়টি তা নয়। অসমের বিজেপি সরকার প্রবল বাঙালি বিদ্বেষী। সেখানে এনআরসি-র নামে বাঙালিরা যে দুর্দশার সম্মুখীন হয়েছিলেন, তা অজানা নয়। এনআরসি-র তালিকা থেকে প্রায় ১৪ লক্ষ বাঙালি হিন্দুর নাম বাদ যাওয়ায় আপাতত তা স্থগিত রাখা হয়েছে। এখন নিম্ন অসমের বাঙালি অধ্যুষিত গোয়ালপাড়া ও সংলগ্ন এলাকায় বাঙালি মুসলমানদের উচ্ছেদ করতে অভিযান চালানো হচ্ছে। অথচ ওইসব বাঙালি বংশপরম্পরায় অসমেরই বাসিন্দা।

    পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপি অত্যন্ত অশালীনভাবে এই অসত্য প্রচারের মাধ্যমে আক্রমণ করছে রাজ্য সরকারকে। এখানেও সীমান্ত পাহারার দায়িত্বে বিএসএফ। অথচ বিএসএফ-এর দায়িত্ব সম্পর্কে বিজেপি নেতারা নীরব। তাঁদের এই ক্রমাগত অসত্য প্রচারে বহু মানুষ প্রভাবিত হচ্ছেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। অন্যান্য রাজ্যেও যখন একইভাবে ভারতীয় বাঙালিদের ‘বাংলাদেশি’ বলে হেনস্থা করা হচ্ছে, তখন বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, এই প্রচার আসলে কেন্দ্রীয় সরকারে থাকা বিজেপি দলটিরই মস্তিস্কপ্রসূত। আর সে কারণে ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও বাঙালিদের প্রতি সেখানকার প্রশাসনের এই একই আচরণ। সম্প্রতি দিল্লির জয়হিন্দ কলোনি তার বড় উদাহরণ। ভারতীয় হলেও এই কলোনির বাসিন্দাদের অপরাধ, তাঁরা বাঙালি এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ। এ কথা কি ভুলে গেলে চলবে যে, পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৩৪ শতাংশ মানুষ মুসলমান সম্প্রদায়ের এবং  তাঁদের শেকড় এই বঙ্গের মাটিতে হাজার বছর ধরে প্রোথিত? তাঁদের মধ্যে অনেকেই বিশেষ বিশেষ কাজে পারদর্শী হওয়ায় অন্যান্য রাজ্যে সেই সব কাজের জন্য তাঁদের ডেকেও নিয়ে যাওয়া হয়। সুতরাং বাঙালির প্রতি হেনস্থা ও অমর্যাদা সামগ্রিকভাবে ভারতীয় বাঙালি জাতির অপমান।

    অন্যদিকে, বিহারে যেভাবে ৪১ লক্ষ নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, তা যথেষ্ট বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিরোধীদের দাবি, এইভাবে বিজেপি বিরোধী ভোট কমানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও এরপর এভাবেই ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। এছাড়াও কেন্দ্রীয় সরকারের তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে যেভাবে বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে কাজে লাগানো হচ্ছে, তা-ও যথেষ্ট উদ্বেগের। এই বিষয়গুলি নিয়ে এবার সংসদের বাদল অধিবেশন উত্তাল হতে চলেছে। ‘ইন্ডিয়া’ জোটের পক্ষ থেকে এই বিষয়গুলি অবশ্যই তুলে ধরা হবে। একুশে জুলাই কলকাতায় যখন শহীদ স্মরণের বিপুল জনসমাবেশে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভাষণ দেবেন, তখন  তৃণমূল কংগ্রেস সহ ইন্ডিয়া জোট এই বিষয়গুলি নিয়েই ঝড় তুলবে সংসদে। তাই আশা করাই যায় যে, এবার একুশে জুলাইয়ের জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভিন রাজ্যে বাঙালির হেনস্থা এবং ইডি ও ইলেকশন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাঁর শাণিত বক্তব্য রাখবেন। সেই সঙ্গে এই বিষয়গুলি হয়ে উঠবে আগামী বিধানসভা নির্বাচনের মূল ইস্যু। সাধারণ মানুষকে মনে রাখতে হবে, বিজেপি মূলত বাঙালি বিরোধী একটি দল। তাই বাঙালির আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার কারণেই এই দলটিকে রাজনৈতিকভাবে বাংলা-ছাড়া করা অত্যন্ত প্রয়োজন। ‘জয় শ্রীরাম’ ছেড়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যতই মুখে ‘জয় মা দুর্গা’ বা ‘জয় মা কালী’ বলুন না কেন, তাতে বাংলার চিঁড়ে ভিজবে বলে মনে হয় না।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)