কয়েক মাস পরেই পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সাধারণ নির্বাচন। পুজোর মরশুমের আগেই ভোটের ঢাক বেজে গিয়েছে। মা-মাটি-মানুষের সরকারের ‘মুখ’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিগত প্রায় তিরিশ বছর ভোটের প্রচারে প্রতিপক্ষকে টেক্কা দিয়ে চলেছেন। এবারও তার ব্যতিক্রম নেই। প্রতিপক্ষরা বরাবরই পিছিয়ে থাকে। এবার ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকেই যে জোড়াফুলকে ভোটের মাঠে মেলে ধরবেন, তা বলাই বাহুল্য।
১৯৯৩ সালে ২১ জুলাই ছিল ঐতিহাসিক সমাবেশ। মহাকরণ অভিযান। ‘নো আইডেনটিটি কার্ড, নো ভোট’ ছিল মমতার নেতৃত্বে সেই অভিযানের প্রধান ইস্যু। তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল সিপিএমের সীমাহীন সন্ত্রাসের প্রতিবাদ। প্রায় ৪১ বছর পর ২১ জুলাইয়ের সমাবেশে নেত্রীর পয়লা নম্বর টার্গেট নির্বাচন কমিশনই। তখনও কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে ছিল বহু প্রশ্ন, আর আজ তো জাতীয় নির্বাচন কমিশন দেশের সংবিধানের মূলে কুঠারাঘাত করতে উদ্যত হয়েছে বলে চর্চা চলছে। নাগরিকদের মৌলিক অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে কমিশন।
১৯৮৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে মমতা ছিলেন ‘জায়েন্ট কিলার’। যাদবপুর কেন্দ্রে সোমনাথ চ্যাটার্জিকে হারিয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন তিনি। রাজ্য রাজনীতিতে নিজেকে অল্প পরিসরেই ‘অগ্নিকন্যা’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন। তার একমাত্র কারণ, সিপিএমের আগ্রাসী রাজনীতির বিরুদ্ধে মমতার আক্রমণাত্মক লড়াই। ১৯৮৭ সালের লোকসভা নির্বাচনে তিনি সিপিএমের বল্গাহীন সন্ত্রাস এবং রিগিংয়ের কাছে হার মানেন। কিন্তু তারপরেও আন্দোলনের ময়দানে তিনি লালপার্টির ঘুম কেড়ে নেন। মমতার ওপর ১৯৯০ সালে, ১৬ আগস্ট হাজরা মোড়ে সেই প্রাণঘাতী নৃশংস আক্রমণ তার প্রমাণ। সেদিন যে মমতাকে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছিল, সেটা অনেকেই মনে করেন।
কয়েক মাস শয্যাশায়ী থাকার পর মমতা পরিণত হলেন ‘বাঘিনী’তে। আরও জঙ্গী হয়ে সিপিএম-বিরোধী আন্দোলনে ঝড় তুললেন। এবং রণাঙ্গনে কার্যত তিনি একা! কংগ্রেস তখন অবিভক্ত। মমতা বাদে দলের প্রথম সারির অধিকাংশ নেতা-নেত্রী আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের হাতে তামাক খেতে ব্যস্ত। ১৯৯১ সালের লোকসভা নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে জিতলেন। মমতা কেন্দ্রের মন্ত্রীও হলেন। কিন্তু অচিরেই বুঝলেন, সিপিএম-বিরোধী লড়াইয়ে তাঁকে নিষ্ক্রিয় করতেই মন্ত্রিত্বের লালিপপ! ১৯৯২ সালে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্বে ইস্তফা দিলেন। এটাওরাজ্য রাজনীতির এক ঐতিহাসিক অধ্যায়।
পরবর্তী ইতিহাসের অধ্যায় হল, ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাইয়ের মহাকরণ অভিযান। কংগ্রেসের মধ্যে মমতা তখন কার্যত একঘরে। কিন্তু দলের কর্মী-সমর্থকরা যেন তাঁর নেতৃত্বে দ্বিতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধে নেমেছে। যেখানে মমতা, সেখানে জনতা। কার্যত ওই অভিযানের দিন কলকাতায় জনবিস্ফোরণ হল। প্রশাসন এবং আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের সব হিসাব ফেল করে লক্ষ লক্ষ মানুষ মমতার ডাকে শহরে পৌঁছে গেল।
সেদিন এই প্রতিবেদক জননেত্রীর সঙ্গেই কালীঘাট থেকে এক গাড়িতে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। সঙ্গী বলতে ছিলেন শ্রীরামপুরের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সে এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। বেলা বারোটা নাগাদ যখন আমরা পৌঁছই ডালহৌসি অঞ্চলে, তখন গোটা চত্বর বস্তুত যুদ্ধক্ষেত্র। পুলিশের ছোঁড়া টিয়ারগ্যাসের সেলের ধোঁয়ায় সবার চোখ জ্বলছে। দূরে কিছু দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। উত্তেজিত কর্মী-সমর্থকরা মমতার কাছে এসে পুলিশের অত্যাচারের কথা বলতে চাইছিলেন। কিন্তু পুলিশ তখন চারদিকে বন্যার বেগে মানুষের আগমণ টের পেয়ে রীতিমতো নার্ভাস। কোনওমতে মমতাকে আহত করে ঘটনাস্থল থেকে হাসপাতালে পাঠিয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে পুলিশ। বামফ্রন্ট সরকারের ‘ট্রিগার হ্যাপি’ পুলিশের গুলিতে সেদিন নিরীহ এবং নিরস্ত্র ১৩ জন কংগ্রেস কর্মী লুটিয়ে পড়েন রাজপথে। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পেরে দিল্লি থেকে প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওয়ের নির্দেশে তৎকালীন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এস বি চ্যাবন ছুটে আসেন কলকাতায়। হাসপাতালে গিয়ে মমতাকে তো বটেই আহত দলীয় কর্মীদের দেখতেও যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
যে কংগ্রেসের কর্মীরা সেদিন দলের জন্য নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করলেন, সেই কংগ্রেস আজ সিপিএমের পরম বন্ধু। হরিহর আত্মা। আর মমতা মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসেও ভোলেননি ১৩ জন শহিদ এবং সেদিনের বর্বর ঘটনার কথা। ৩২ বছর পরে পরিস্থিতির পরিবর্তন হলেও, মমতা রয়েছেন লড়াইয়ের ময়দানে। সেদিন ভোটারদের আইডেন্টি কার্ড না থাকায় সিপিএম বাংলায় একের পর এক নির্বাচনে ছাপ্পা এবং রিগিং চালিয়েছে অবাধে। মমতার আন্দোলনে পরবর্তী সময়ে ভোটার আইডেনটিটি কার্ড চালু হয় এবং নির্বাচনে রিগিং অনেকটাই বন্ধ হয়। তারই ফলশ্রুতি হল, ৩৪ বছর বামফ্রন্টের বকলমে সিপিএমের অপশাসনের অবসান। মমতার রাজ্যপাটে অভিষেক।
আজ তো নির্বাচন কমিশন আরও অনেক বেশি পক্ষপাতদুষ্ট। সরকারি দলের হয়ে এইরকম নির্লজ্জ দালালি করতে নির্বাচন কমিশনকে অতীতে কেউ কোনওদিন দেখেনি। প্রথমে মহারাষ্ট্র বিধানসভার নির্বাচনের কথাই ধরা যাক। কয়েকমাস আগে সে রাজ্যের নির্বাচনে দেখা গেল, ভোটার তালিকায় প্রায় ১ কোটি নতুন মানুষের নাম। কোথা থেকে এল এইসব ভূতুড়ে ভোটার, তার জবাব আজও নির্বাচন কমিশন দিতে পারেনি। আরও হাস্যকর কাণ্ড হল, ভোটের পর শতাংশের হিসাব নিয়ে। সাধারণত যে কোনও ভোটের পরদিনই নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দেবে, কত শতাংশ মানুষের ভোট পড়েছে। মহারাষ্ট্রে দেখা গেল ১০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার পর কমিশন সেই হিসাব দিল।
এখন ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে এক বিপজ্জনক খেলায় নেমেছে নির্বাচন কমিশন। যারা বিজেপিকে ভোট দেবে না, কার্যত কৌশলে তাদের নাম নানা ছুতোয় তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে কমিশন। এই লেখা যখন লিখছি, তখন বিহারে এমন ৪০ লক্ষ ভোটারের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিহারে আর কয়েক মাস পরেই ভোট।
কমিশনের টার্গেট যে বাংলাও সেটাও টের পাওয়া যাচ্ছে। এক্ষেত্রে আরও বিপজ্জনক পরিস্থিতি বিভিন্ন রাজ্যে মাথাচাড়া দিচ্ছে। সেটা হল, বাংলাভাষী হলেও তাঁকে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে দাগিয়ে দেওয়া। বাঙালিরা যে ভারতবাসী নন, এমনই আচরণ করছে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির সদস্যরা।
তাই নির্বাচন কমিশন এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক দিল্লির বিজেপির সরকারের বাঙালির-বিরোধী ভূমিকার বিরুদ্ধে পথে নেমেছেন মমতা। এবারের ২১ জুলাই বাংলার প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের বঞ্চনা এবং নির্বাচন কমিশনের সংবিধান বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সরব হতে চলেছেন মমতা। তাঁর এই লড়াই যে আগামী বিধানসভার নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের মস্তবড় হাতিয়ার হবে, সেটা অনুমান করাই যায়। মমতা ফের প্রমাণ করতে চান, বাংলা এবং বাঙালির রক্ষাকবচ তিনিই, আর কেউ নন।