• একুশে জুলাই বুঝিয়ে দেয় মমতা এখনো প্রতিষ্ঠান বিরোধী
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ২১ জুলাই ২০২৫
  • রন্তিদেব সেনগুপ্ত, বিশিষ্ট সাংবাদিক

    উনিশশো তিরানব্বই সালের একুশে জুলাইয়ের পর বত্রিশটি বছর কেটে গিয়েছে। মাঝের এই বত্রিশ বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়ম করে প্রতিটি বছর একুশে জুলাই ধর্মতলায় শহিদ স্মরণে সভা করেছেন। প্রতিটি সভাতেই তাঁর দলের তৃণমূল স্তরের কর্মীদের উৎসাহ, উদ্দীপনা এবং ভিড় রাজনৈতিকভাবে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। বত্রিশ বছরে একুশে জুলাইয়ের সমাবেশ রাজ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। এই বত্রিশ বছরের ভিতর তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধী দল থেকে ক্রমে সরকারি ক্ষমতায় আসীন হয়েছে। প্রায় পনেরো বছর ক্ষমতায় কাটিয়ে দিয়েছে তারা। গঙ্গা দিয়ে অনেক জলও গড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একুশে জুলাইয়ের সমাবেশের গুরুত্ব কখনো কমতে দেননি।

    কেন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে একুশে জুলাইয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। মমতা নিজে আন্দোলনের ফসল। আন্দোলনের মুখ। মমতা জানেন, দলের আন্দোলনমুখী ভূমিকাটি হারিয়ে গেলে দল জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যেমনটি চৌত্রিশ বছর ক্ষমতায় থেকে হয়েছিল সিপিএম। মমতার নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেসও নয় নয় করে প্রায় পনেরোটি বছর ক্ষমতায় কাটিয়ে ফেলল। পনেরো বছর ক্ষমতায় থাকার পরও দলকে আন্দোলনমুখী রাখা কষ্টকর এবং কঠিন কাজ। মমতা এই কষ্টকর এবং কঠিন কাজটিই প্রতিবছর একুশে জুলাইয়ে নিয়ম করে করেন।

    ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই মমতার ডাকে মহাকরণ অভিযানের ভিতর দিয়েই কার্যত তৃণমূল কংগ্রেসের জন্মের বীজটি বপন হয়েছিল। ওই সময় মমতা প্রদেশ যুব কংগ্রেস সভানেত্রী। সেই সময় প্রদেশ কংগ্রেসের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর কাছের মানুষ মমতা ছিলেন না। প্রদেশ কংগ্রেস সেই সময় আন্দোলন বিমুখ বিবৃতি সর্বস্ব একটি সংগঠনে পরিণত হয়েছিল। ফলে কংগ্রেসের সাধারণ কর্মী সমর্থকরা নেতৃত্ব সম্পর্কে হতাশ এবং ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছিলেন। এহেন রাজ্য কংগ্রেসে তখন একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর আন্দোলনমুখী মেজাজ এবং কর্মকাণ্ড দলীয় কর্মীদের ভিতর জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে তুলেছিল। এইরকম একটি পরিস্থিতিতে ‘৯৩ -এর ২১ জুলাই মমতা মহাকরণ অভিযানের ডাক দিয়েছিলেন।

    মমতার সেই ডাক আন্দোলনহীন কংগ্রেসে সাধারণ কর্মীদের ভিতর উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল। জেলাগুলি থেকে দলে দলে কংগ্রেস কর্মীরা এসে সেই কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছিল। কার্যত সেদিন কলকাতা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। মমতা বুঝে গিয়েছিলেন, তাঁর ডাকে দলের কর্মীরা এরপর থেকে ছুটে আসবেন। ওইদিনের ওই কর্মসূচি তাঁকে আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিল। সেই আত্মবিশ্বাসই তাঁকে পরে কংগ্রেস ত্যাগ করে নতুন দল গড়তে উৎসাহী করেছিল।

    এরপর থেকে প্রতিবছর নিয়ম করে মমতা একুশে জুলাইয়ের সমাবেশ ডেকেছেন ধর্মতলায়। ঝালিয়ে নিয়েছেন নিজের আকর্ষণী শক্তি। এবং এখনো সরকারে আসীন হয়ে প্রতিবছর নিজের এই শক্তিটা পরখ করে নিতে মমতা ভোলেন না। এবং প্রতিবছরই প্রমাণ হয়ে যায় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরও মমতাই হচ্ছেন সেই নেত্রী, যাঁর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক ক্যারিশমায় এখনো কোনো ক্ষয় ধরেনি।

    ‘৯৩ -এর ওই ২১ জুলাইয়ের আন্দোলনে প্রদেশ কংগ্রসের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ছিল না। তাঁরা সযত্নে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন এর থেকে। আর এটাই ছিল তাঁদের চরম মারাত্মক ভুল। একুশে জুলাইয়ের মহাকরণ অভিযানে একতরফাভাবে পুলিশের গুলিচালনা সারা দেশে নিন্দার ঝড় তুলেছিল। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেও মমতার গুরুত্ব বেড়েছিল। যে আন্দোলনটি প্রদেশ কংগ্রেসের আন্দোলন হতে পারত, কংগ্রেস নেতাদের অবিমৃষ্যকারিতার ফলে তা ক্রমে হয়ে দাঁড়ালো মমতার আন্দোলন। আর এখন তো একুশে জুলাই আর মমতা সমার্থক হয়ে গিয়েছেন। হয়তো কংগ্রেস নেতৃত্ব এজন্য এখন আক্ষেপই করেন।

    রাজ্যের রাজনীতিতে একুশে জুলাইয়ের সমাবেশের একটি আলাদা গুরুত্ব আছে। এই সমাবেশে বিপুল জনসমাগমই যে তার একমাত্র কারণ তা নয়। বিরোধী নেত্রী থাকার সময় যেমন, তেমনই এখনো এই সমাবেশ থেকেই মমতা তাঁর দলের নেতা— কর্মীদের আগামি একবছরের দলের চলার পথটি নির্দেশ করে দেন। ফলে শুধু তাঁর দলের নেতা-কর্মীরা নন, রাজনৈতিক মহল এবং রাজনীতি বিশেষজ্ঞরাও উদগ্রীব হয়ে থাকেন একুশে জুলাইয়ের এই সমাবেশটি নিয়ে।

    মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আন্দোলনের ফসল। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ভিতর দিয়ে তাঁর উত্থান। যদি কেউ খুব গভীরভাবে লক্ষ করেন তাহলে দেখবেন, মমতা তাঁর প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার চেহারাটি এখনো হারাননি। সেটা কেন্দ্র সরকারের অসাংবিধানিক কাজকর্ম, উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরোধিতা থেকে ভিন রাজ্যে বাঙালিদের ওপর হেনস্থার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠা থেকে বোঝা যায়। ভারতে আর কোনো রাজনীতিক বোধহয় এই মুহূর্তে নেই যিনি পনেরো বছর ক্ষমতায় থাকার পরও নিজের প্রতিষ্ঠান বিরোধী একটি চরিত্র ধরে রাখতে পেরেছেন। সে অর্থেও মমতা একজন ব্যতিক্রম। একুশে জুলাইয়ের সমাবেশে যে আন্দোলনমুখী কর্মসূচির ডাক তিনি দেন, সেই কর্মসূচির ভিতর শাসকের বদলে বিরোধী নেত্রীর প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ঝাঁঝটি লক্ষ করা যায়। তবে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুটি অবশ্য কালের নিয়মেই বদল হয়েছে। যদি ভুল না করে থাকি, তাহলে এবার একুশে জুলাইয়ের সমাবেশে বিজেপি শাসিত রাজ্যে বাঙালিদের হেনস্থার বিরুদ্ধে দলের আক্রমণাত্মক কর্মসূচির রূপরেখা নির্দিষ্ট করে দেবেন তিনি।

    আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনো বদল হয়নি। একুশে জুলাই বারবার সেটা প্রমাণ করে দিয়ে যায়। আন্দোলন থেকে উঠে আসা মমতা জানেন আন্দোলনই তাঁকে রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক রাখবে। শহুরে উচ্চবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত এককথায় হোয়াইট কলার সিটিজেনসদের তীর্যক মন্তব্যকে উপেক্ষা করেই তিনি তাঁর মতো মিছিল করেন, সমাবেশ করেন, আমজনতার ভাষায় সভামঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেন। এবং দিনের শেষে প্রমাণ করে দিয়ে যান, রাজনীতিটা তাঁর থেকে ভালো কেউ বোঝে না।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)