মাসখানেক পরেই ভিন্ দেশ থেকে আসবে ওরা। গঙ্গার দু’ধারে চর এলাকায় গড়ে উঠবে বসতি। ওরা, পরিযায়ী পাখি। ফি বছর মালদহের গঙ্গার তীরের এলাকায় এই ছবি পরিচিত। পরিযায়ী পাখিদের আগলে রাখতে সচেতনতা প্রচার অভিযান চালায় বন দফতর। পাশে দাঁড়ায় পাখিপ্রেমী সংগঠনগুলিও।
কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিকদের আগলে রাখবেন কে?
এই প্রশ্ন এখন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের কফিন-বন্দি দেহ ভিন্ রাজ্য থেকে ফিরতে দেখেছি। গত বছর মিজোরামে নির্মীয়মাণ রেলসেতু ভেঙে মালদহের চৌদুয়ারের বাসিন্দা ১১ জন শ্রমিকের দেহের ঘরে ফেরা, তাঁদের স্বজনদের কান্না এখনও কানে বাজে। তবে এ বার নতুন সমস্যায় পরিযায়ী শ্রমিকেরা। বাংলায় কথা বলায় বাংলাদেশি সন্দেহে আটক হতে হচ্ছে ভিন্ রাজ্যের পুলিশের হাতে। বাসিন্দাদের হাতে নিগৃহীতও হচ্ছেন অনেকে।
বাংলার গ্রামাঞ্চল থেকে হাজার হাজার শ্রমিক জীবিকার সন্ধানে ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দেন। কৃষি বা স্থানীয় স্তরে কাজের চাহিদা কম, দারিদ্র, আর্থিক অনিশ্চয়তা, অতিরিক্ত আয়ের আশা তাঁদের বাধ্য করে পরিবার-পরিজন ছেড়ে অজানা শহর, জনপদে পাড়ি দিতে। সাম্প্রতিক কালে ওড়িশা, উত্তর প্রদেশ, অসম, দিল্লির মতো রাজ্যে বাঙালি শ্রমিকদের উপরে হেনস্থা নতুন মাত্রা পেয়েছে । তাঁদের বাংলা কথা শুনে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। পুলিশের পরিচয়পত্র যাচাইয়ে আড়ালে প্রায়ই ওঠে হয়রানির অভিযোগ। অনেককে রাতের অন্ধকারে ধরে নিয়ে গিয়ে মারধর করা হচ্ছে। আইন অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোর্টে না তুলে পুলিশ আটকে রাখছে দিনের পর দিন। না দিচ্ছে পর্যাপ্ত জল, খাবার। অস্বাস্থ্যকর থাকার জায়গা। শুধু তাই নয়, তাঁদের অনেক সময় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে সীমান্তের ও-পারে বাংলাদেশে। এমনকি শিশুরাও ‘পুশব্যাকের’ শিকার। যেখানে তাদের পরিবারের সদস্যেরাও জানেন না, প্রিয়জন কোথায়।
২০১৫ সালে ভারত সরকার ছিটমহলের বাসিন্দা, পরিযায়ী শ্রমিক সামসুল হকদের নাগরিকত্ব প্রদান করে। আর সেই নাগরিকত্বকে অস্বীকার করে বাংলাদেশি তকমা দিয়ে তাঁদের আটক করে দিল্লি পুলিশ। মুর্শিদাবাদের শমসেরগঞ্জের সুজন সরকারকে বেধড়ক মারধর করা হয় ওড়িশায়। আতঙ্কে এখন অনেকে নিজের গ্রামে ফিরে আসছেন। তাতেও সমস্যা শেষ হয় না— কারণ এখানেও আর্থিক সঙ্কট, ঋণের দায়, কাজের অভাব তাঁদের পিছু ছাড়ে না। ২১ এপ্রিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে চিঠি দেওয়া হয়েছে সংগঠনের তরফে। তথ্য জানার অধিকার আইনে জানতে চেয়েছি, কোন কোন নথি দেখালে পরিযায়ী শ্রমিকদের ভারতীয় নাগরিক হিসেবে মান্যতা দেওয়া হবে?
সদুত্তর মেলেনি।
এমন পরিস্থিতিতে পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে আসতে হবে রাজ্য সরকারকে। প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় বাড়িয়ে সুনির্দিষ্ট ভাবে ভিন্ রাজ্যে কাজে যাওয়া শ্রমিকদের তালিকা তৈরি করে তাঁদের জীবন-জীবিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত আন্তঃরাজ্য শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য কঠোর আইন প্রয়োগ করা ও পরিযায়ী শ্রমিকদের সাংবিধানিক অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখা। সবচেয়ে জরুরি, এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সচেতন নাগরিক সমাজকে রাস্তায় নামতে হবে। ভাষা, ধর্ম, রাজ্য নির্বিশেষে শ্রমিকদের মর্যাদা রক্ষা করতে হবে।
রাজ্যের পরিযায়ী ঐক্য মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক, মাদ্রাসার শিক্ষক, মালদহ