• বাংলায় কথা অপরাধ? প্রশ্ন পরিযায়ী-ঘরে
    আনন্দবাজার | ২১ জুলাই ২০২৫
  • সরু উঠোনের পাশে ততোধিক সরু টিনের ঝুপড়ি। ভিতরে অন্ধকার যেন দানা বেঁধে আছে। অভাব নিত্যসঙ্গী। গত বুধবার থেকে সেই অন্ধকার আরও গাঢ় হয়েছে। সে দিন দুপুরে এই সব বাড়ির ছেলেদের আটক করেছে হরিয়ানা পুলিশ। তার পর থেকে অজানা আশঙ্কায় কেটেছে প্রতিটি মুহূর্ত। উঠোনের এক কোণে পেয়ারা গাছের নীচে বসে একটানা কেঁদে চলেছে বছর দেড়েকের শিশু। তার দিকে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। একটাই প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে, “কী অপরাধ করেছে আমাদের বাড়ির ছেলেরা?”

    চাপড়ার বাঙ্গালঝি এলাকার বাসিন্দা শুকুর আলি শেখ, তাঁর দুই ভাই বসির শেখ ও আনাজ শেখ স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে থাকেন হরিয়ানার ফরিদাবাদে। তিন জনেই ভাঙা লোহালক্কড়ের ব্যবসা করেন। তারা সেখানে আছেন প্রায় বিশ বছর ধরে। শুকুরের মা ছাইবা বেওয়ার বয়স প্রায় সত্তর। তিন ছেলে আর এক নাতজামাই পুলিশের হাতে ‘বন্দি’ হওয়ার খবর পাওয়া ইস্তক তিনি ছটফট করছেন। প্রশ্নে-প্রশ্নে অস্থির করে তুলছেন নাতিনাতনিদের। বার বার করে জানতে চাইছেন, “ওদের কখন ছাড়বে?”

    শনিবার দুপুরে উৎকণ্ঠা নিয়ে তিনি বসেছিলেন টিনের ছোট্ট ঘরটার সিঁড়ির উপর। বাইরের লোক এক নিঃশ্বাসে একটার পর একটা প্রশ্ন করে যান, “কোনও খারাপ খবর না তো? ওদের কী ছেড়ে দিয়েছে? কবে ছাড়বে? আদৌ ছাড়বে তো?” তাঁকে কেউই কোনও কথা বলে আশ্বস্ত করতে পারে না। ঘর থেকে বেড়িয়ে আসেন শুকুর আলির দুই ছেলেমেয়ে। তাঁরা জানান, ঈদে বাড়ি এসেছিলেন সবাই। মঙ্গলবার ফিরে যান। বুধবার পৌঁছে খাওয়াদাওয়া সেরে সবে বিছানায় গা এলিয়েছেন, ঠিক সেই সময় হাজির হয় হরিয়ানা পুলিশ।

    শুধু শুকুর আলি শেখরাই নয়, আছেন পাশের পাড়ার বাপ্পা শেখ, বাদলাঙ্গির বাসিন্দা আশরাফুল মোল্লা— চাপড়ার কল্যাণদহ, শিকরা, গোয়ালডাঙা-লক্ষ্মীপুর, দুধখোলা এলাকার মোট ১৫ জন। এঁদের বেশির ভাগই ভাঙা লোহালক্কড়ের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কেউ ঘুরে-ঘুরে সে সব সংগ্রহ করেন তো কেউ বেচা-কেনা করেন। বাদলাঙ্গির বাসিন্দা আশরাফুল স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আঙ্খীর গাঁওয়ে থাকেন। তিনি রাস্তায় ঘুরে ঘুরে লোহালক্কড় সংগ্রহ করে বিক্রি করেন। দিনে গড়ে প্রায় চারশো টাকা আয় হয়। প্রায় দু’বছর তিনি বাড়ি আসেননি।

    কথাটা বলে প্রায় আর্তনাদের মত প্রশ্নটা ছুড়ে দেন আশরাফুলের বৃদ্ধ বাবা ছোরাবুদ্দিন মোল্লা, “পুলিশ ওকে ছেড়ে দেবে তো? আমার সঙ্গে আবার দেখা হবে তো?” গ্রামের এক প্রান্তে কবরস্থান পাড়ার এক কোণে বাঁশবাগানের ভিতরে ছোট্ট কুঁড়েঘরে দুই নাতিকে নিয়ে বসবাস করেন এই দম্পতি। বাঁশবাগান দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া পায়ে চলা রাস্তাটার দিকে ছেলের প্রতীক্ষায় রয়েছেন তাঁরা।

    আশরাফুল মুক্ত হওয়ার পর ফোনে প্রশ্নটা তোলেন তাঁর মা, বাদলাঙ্গির বাসিন্দা মনোয়ারা বিবি। বুধবার রাতে ফোন কেড়ে নেওয়ার পর থেকে তাঁরা আর ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। চরম উৎকণ্ঠায় কেটেছে বছর ষাটেকের বৃদ্ধার। বৌমার সঙ্গে এক নাতিও আছে। তারা কোথায়, কেমন আছে, কিছুই জানতে পারেননি। বুধবার রাত থেকে গলা দিয়ে ভাতের কণাও ঢুকতে চাইছে না। তিনি বলেন, “আমি বুঝতে পারছি না, ছেলের অন্যায়টা কী? বাংলায় কথা বলাটা কি এই দেশে অপরাধ?”

    চাপড়ার বিধায়ক তথা তৃণমূলের কৃষ্ণনগর সাংগঠনিক জেলা চেয়ারম্যান রুকবানুর রহমান বলেন, “যে ভাষায় জাতীয় সঙ্গীত লেখা হয়েছে, সেই ভাষার প্রতি এই অপমান মানুষ মেনে নেবে না।” কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার সুপার অমরনাথ কে বলেন, “প্রয়োজনীয় নথিপত্র-সহ বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে। হরিয়ানা পুলিশের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে ওঁদের মুক্ত করা হয়েছে।”
  • Link to this news (আনন্দবাজার)