বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ জঙ্গল, প্রায় ৩৫টি নদী, বঙ্গোপসাগরে ঘেরা দ্বীপপুঞ্জ সুন্দরবনের বাসিন্দাদের ৭০ শতাংশই কৃষি নির্ভর। কিন্তু প্রকৃতির প্রতিকূলতায় ফি বছর এই দ্বীপাঞ্চলে বিপর্যয় দেখা যায় কৃষিতে। সেই কারণে এলাকার মহিলাদের নিয়ে বিকল্প কৃষি ব্যবস্থার কাজ শুরু হয়েছে।
২০০৯ সালে আয়লার পরে গোসাবা, ছোট মোল্লাখালি, চণ্ডীপুর, লাক্সবাগানের মতো দ্বীপগুলিতে নোনা জল ঢুকে যাওয়ায় চাষযোগ্য জমি ছিল না বললেই চলে। গোসাবার প্রায় ৩৫০০ পুকুর ব্যবহারের অযোগ্য হয়েছিল। ধান থেকে আনাজ, এমনকি মাছ চাষে যুক্তগরিব মানুষগুলি কার্যত দিশাহারা হয়েছিলেন। আর আজ প্রতিকূলতাকে বাজি রেখে ৫৪ শতাংশ মহিলা কৃষিনির্ভর হয়েছেন এই দ্বীপগুলিতে। সেই গল্পই শোনালেন অস্ট্রেলিয়ার কমনওয়েলথ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ অর্গানাইজেশন (সিএসআইআরও)-এর প্রজেক্ট লিডার কৃষিবিজ্ঞানী মহম্মদ মইনুদ্দিন, নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রশাসনিক প্রধান স্বামী শিবপূর্ণানন্দ ও বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কৌশিক ব্রহ্মচারী।
শুক্রবার নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রামীণ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগে সুন্দরবনের কৃষি উন্নয়নে গবেষণা ও তা বাস্তবায়নের রূপরেখা তৈরি করা এবং গত দশ বছরের কাজের খতিয়ান নিয়ে হওয়া আলোচনাসভায় কৃষি নির্ভর গ্রাম বিকাশে মহিলাদের যোগদানের বিষয়টি উঠে আসে।
২০১৬ সাল থেকে ভারত ও বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকায় রিমোট সেন্সিং জিআইএস-এর মাধ্যমে কৃষিজমিতে লবণাক্ততা পরিমাপ করার পাশাপাশি গ্রামগুলিতে বিকল্প কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলায় জোর দিয়েছেন রাজ্যের কৃষি বিজ্ঞানীরা। আলোচনায় উপস্থিত অস্ট্রেলিয়া সরকারের সেন্টার ফর এগ্রিকালচারাল রিসার্চ-এর দক্ষিণ এশিয়ার রিজিয়োনাল ম্যানেজার প্রতিভা সিংহ বলেন, ‘‘ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার কৃষি বিজ্ঞানীদের যৌথ উদ্যোগেই মুখ থুবড়ে পড়া সুন্দরবনের কৃষি ব্যবস্থাকে সচল করে স্বনির্ভর হয়েছেন প্রান্তিক দ্বীপ এলাকার মেয়েরা। বার্ষিক এক ফসলি জমিকে বহু ফসলি করা গিয়েছে। সুন্দরবনের কৃষি ব্যবস্থা এখন বিশ্বের কৃষি-গবেষকদের কাছে পাখির চোখ।’’
মইনুদ্দিন বলেন, ‘‘জলের মধ্যে আনাজ চাষ ও জিরো টিলেজ পটেটোতে সাড়া ফেলেছে সুন্দরবন। ক্যানিংয়ের কেন্দ্রীয় মৃত্তিকা লবণাক্ততা গবেষণা সংস্থাও সুন্দরবনের চাষিদের দিশারী এখন। বীজ থেকে সার সমস্ত কিছু দিয়ে দশ বছর আগে ৭৮ জন চাষিকে নিয়ে যে সমবায় কৃষি তৈরি হয়েছিল আজ সেই সংখ্যা ২৩৪০-এ পৌঁছেছে। যার সিংহ ভাগ মহিলারাই সামলাচ্ছেন। উৎপাদন বাড়ায় হিমঘরের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন চাষিরা। শুধু চাষিরাই নন, গত দশ বছরের এই গবেষণায় গ্রামগুলিতে চাষিদের ঘরে থেকে তাঁদের সঙ্গে হাতেকলমে কাজ করে পিএইচডি করেছেন বহু গবেষক। এটাও সাফল্যের।’’
ধান, আলু, টোম্যাটো, মাচার ফসল-সহ নানা আনাজ ফললেও কৃষি জমি, নিকাশি ব্যবস্থা ও মিষ্টি জলের সমস্যা রয়েছে সুন্দরবন এলাকায়। বহু চাষযোগ্য জমি ভেড়িতে পরিণত হয়েছে জমি-হাঙরদের কবলে পড়ে। প্রতিকূলতার সঙ্গে যুঝে মহিলাদের নিয়ে আরও বেশি করে সমবায় গড়ে চিরাচরিত ও বিকল্প কৃষির প্রসার ঘটানোয় উদ্যমী হওয়ার কথা জানিয়েছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা।
বালি দ্বীপের শম্পা মাইতি, সুষমা গায়েনরা বলেন, ‘‘আমাদের এখানে আগে কখনও মেয়েরা চাষ করেনি। নোনা জলে জমি নষ্ট হওয়ায় আশা ছেড়েছিলাম সবাই। কিন্তু এক ঝাঁক গবেষক, বিজ্ঞানী কার্যত জোর করেই চাষের নেশা ধরালেন। এখন বাজারজাত করার মতো ফসল উৎপাদন হচ্ছে। ফসল মজুত করার ব্যবস্থা হলে ভাল হয়।’’