• বাড়তি আয়ের টোপে কোটি টাকার প্রতারণা
    আনন্দবাজার | ২১ জুলাই ২০২৫
  • স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যদের বাড়তি আয়ের স্বপ্ন দেখিয়ে তাঁদের মাধ্যমে ঋণের কোটি কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছে প্রতারকেরা। পুলিশের কাছে অভিযোগ হলে কখনও তারা ধরা পড়ে, কখনও নয়। কিন্তু আইনি জটিলতায় প্রতারকদের কাছ থেকে সেই টাকা উদ্ধার করা যায় না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। ফলে আখেরে ভুগছেন সেই স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যেরা।

    গত কয়েক বছরে রঘুনাথপুর মহকুমার বিভিন্ন গ্রামে প্রতারণার জাল বিছিয়েছে প্রতারকেরা। বিভিন্ন সূত্রের দাবি, রঘুনাথপুর শহর থেকে সাঁওতালডিহি, কাশীপুর ও পাড়া থানা এলাকার স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের কাছ থেকে ১২-১৪ কোটি টাকার প্রতারণা করেছে তিন-চার জন। তবে, অভিজ্ঞদের মতে, এটা হিমশৈলের চূড়া মাত্র। কারণ ওই সব থানায় কয়েক জন মহিলা অভিযোগ দায়ের করায় প্রতারণার আনুমানিক অঙ্ক পাওয়া গিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে প্রতারণার টাকার অঙ্ক হয়তো অনেক বেশি। সমস্ত প্রতারিত মহিলা অভিযোগ করলেই তা স্পষ্ট হবে।

    পুলিশ সূত্রে খবর, রঘুনাথপুরের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত গ্রেফতার হলেও পরে জামিনে ছাড়া পেয়েছে। কাশীপুর ও পাড়ার ঘটনায় মূল অভিযুক্ত এক জনই, তিনি আদ্রা থানার বাঘাডাবর গ্রামের বাসিন্দা। অভিযোগের পরেই সে পলাতক ছিল। পরে রঘুনাথপুর আদালতে আত্মসমর্পণ করে জেলে যায়।

    তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, প্রতারণার পদ্ধতি সব ক্ষেত্রেই এক। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার নাম করে প্রতারকেরা প্রথমে ব্লকের কয়েকজন মহিলাকে বাছাই করেন। তাঁদের মাধ্যমে ব্লকের অন্য মহিলাদের মধ্যে প্রচার করা হয়, সেলাই শিখে বাড়তি রোজগার করার বিরাট সুযোগ এসেছে। প্রশিক্ষণের পরে ওই মহিলাদের বলা হত, কাজ পেতে হলে সেলাই মেশিন কিনতে হবে। সে সামর্থ্য অধিকাংশের নেই। তখনই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে প্রস্তাব দেওয়া হত, তারাই ব্যাঙ্ক বা স্মল ফিনান্স কোম্পানি থেকে ঋণের ব্যবস্থা করে দেবে।কিস্তির টাকাও তারা শোধ করে দেবে। শুধু ঋণ নেওয়া হবে ওই মহিলাদের মাধ্যমে।

    কাশীপুর ও পাড়া থানায় অভিযোগ দায়ের করা রেখা কুম্ভকার, চন্দনা মাহাতোরা জানান, গ্রামের দুঃস্থ মহিলাদের কাছে এই প্রস্তাব ছিল অত্যন্ত লোভনীয়। ঋণের টাকা তাঁদের শোধ করতে হবে না। বরং কাজ করে কিছু বাড়তি রোজগার হবে। তাঁরা বলেন, ‘‘তাই কোনও কিছু চিন্তা না করেই ওই প্রতারকদের কথা মতো ঋণ নিয়েছিলাম সবাই। ঋণের টাকা তাঁদের হাতেই তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু নানা বাহানা দেখিয়ে সেলাই মেশিন দেয়নি। এক বছর ঋণের কিস্তির টাকা শোধও করলেও পরে ওরা গাঢাকা দেয়। আমরা বিপদে পড়ে যাই।’’

    রেখার দাবি, কাশীপুরের অন্তত ৩০টি গ্রামের প্রায় তিনশো মহিলা গড়ে প্রত্যেকে ৩৫ হাজার টাকা ঋণ নেন। সে অর্থে, কাশীপুর থেকেই প্রতারকেরা দশ কোটির বেশি টাকা লুটেছে। পাড়া ব্লকে অন্তত পনেরো গ্রামের প্রায় একশো জনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে প্রতারকেরা। এখানে প্রতারণার অঙ্ক পাঁচ কোটির কাছাকাছি।

    পাড়া ও কাশীপুরের আগে একই ঘটনা ঘটেছিল রঘুনাথপুর শহরে। সেখানে পদ্ধতিটা ছিল একটু আলাদা। এক দম্পতি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের বুঝিয়েছিল, বিনামূল্যে তাঁদের কয়েক হাজার টাকা, দামি শাড়ি ও গয়না দেওয়া হবে। বিনিময়ে, ওই মহিলাদের নামে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেওয়া হবে। ঋণের টাকা দম্পতিই পরিশোধ করবে। ফলে ঋণ হিসেবে পাওয়া টাকা দম্পতিকে অনেকেই তুলে দেন। পরে দম্পতি উধাও হতে তাঁদের ভুল ভাঙে।

    দেড়শোর বেশি মহিলার কাছ থেকে কোটি টাকার বেশি নিয়ে প্রতারণা করা হয় বলে অভিযোগ। তাঁরা বলছেন, ‘‘দম্পতির মিষ্টি কথায় তাঁরা ভুলেছিলেন। এখন ঋণদানকারী সংস্থা ও ব্যাঙ্কের লোকজন কিস্তির টাকা চেয়ে তাঁদের জীবন দুর্বিষহ করে দিচ্ছে। ঋণ নেওয়ার আগে বাড়িতে আলোচনা না করায় ঘরের লোকের কাছেও গঞ্জনা শুনতে হচ্ছে অনেককে।

    কিন্তু প্রতারকদের জব্দ করা যাচ্ছে না কেন?
  • Link to this news (আনন্দবাজার)