বোনের সঙ্গে প্রেমে বাধা! ‘জিগরি দোস্ত’ থেকে শেরুর ‘চরম শত্রু’ চন্দন, পাটনা গুলি কাণ্ডে চাঞ্চল্যকর তথ্য
প্রতিদিন | ২১ জুলাই ২০২৫
সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: শেরু ?“কা বাবা, প্রণাম, সব ঠিক বা নু?”চন্দন- “হাঁ, বাবু সাহেব সব ঠিক বা। “চন্দন- “বাবু সাহেব, শুননি হ কি তু হমার রেকি করবতরও। ” শেরু- “ন বাবা, এহসন কৌন বাত নেইখি।”
বিহারের পাটনার বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গ্যাংস্টার চন্দন মিশ্রের খুনের ৪ দিন আগে ভোজপুরি ভাষায় এটাই ছিল নিহত চন্দন মিশ্র ও শেরু সিংয়ের শেষ কথোপকথন। আর এই কথোপকথনের সূত্র ধরেই বিহারের গ্যাংস্টার চন্দন মিশ্র খুনে রাজ্য পুলিশের এসটিএফ বড়সড় সাফল্য পেল। কলকাতার নিউটাউন ও আনন্দপুর মিলিয়ে ধৃতদের বিহার পুলিশের হাতে তুলে দেয় রাজ্য পুলিশ। তাদেরকে ট্রানজিট রিমান্ডে বিহারে নিয়ে যাওয়া হবে। একদিকে ওই কথোপকথন থেকে গ্যাংস্টার খুনে সুপারি কিলারদের পাকড়াও করার সাফল্য।
সেই সঙ্গে ওই কথোপকথনেই রাজ্য পুলিশ তথা বিহার পুলিশের কাছে প্রায় একপ্রকার পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে পুরুলিয়া সংশোধনাগারের বসেই নিহত চন্দনের একসময়ের ‘জিগরি দোস্ত’ চন্দন মিশ্র খুনে নীল নকশা সাজিয়েছিল ওঙ্কারনাথ সিং ওরফে শেরু। ২০২৩ সালের ২৯ শে আগস্ট পুরুলিয়া শহরের সেনকো লুটের ঘটনায় প্রায় দেড় বছরের বেশি সময় ধরে পুরুলিয়া সংশোধনাগারে বিচারাধীন বন্দি ওই শেরু। যেভাবে বিহারের আদর্শনগর সংশোধনাগার বেউড়ে বসে পুরুলিয়ার ওই ব্র্যান্ডেড সোনার দোকান লুটের অপারেশন সাজায়। প্রায় একই ছকে চন্দন খুনের অপারেশনও। জেলে বসেই ব্যবহার করেছিলেন ইন্সটা বলে অভিযোগ। কিন্তু কোথা থেকে এসেছিল মোবাইল, সিম? সেগুলিই খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে কারা কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গিয়েছে। অভিযোগ, ওই ইন্সটাতেই সুপারি কিলারদেরকে ‘ইয়েস’ বার্তা পাঠান শেরু। এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে বিহার পুলিশ। কিন্তু কেন হঠাৎ করে ‘জিগরি দোস্ত’ চন্দন ‘চরম শত্রু’ হয়ে গেলেন?
একদিকে বকরা। সেইসঙ্গে কে দেবে গ্যাং-র নেতৃত্ব? বিহারের জেলে এই নিয়ে মন কষাকষি থেকে উভয়ের সংঘর্ষ পর্যন্ত বেঁধেছিল। এইসঙ্গে চন্দনের ক্রোধ বাড়িয়ে দিয়েছিল, তার এক সম্পর্কীয় বোনের সঙ্গে প্রেম করছিল শেরু। আর তারপরেই আলাদা হয়ে যায় তারা। দুই গ্যাঙের লিডার দু’জন। খানিকটা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে বিহার পুলিশ। কাঁটা দিয়ে কাটা তুলতে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। কিন্তু তার মধ্যেই পাটনার রাজাবাজার এলাকায় বেসরকারি হাসপাতালে ১৭ই জুলাই সকাল সাতটা নাগাদ খুন হয়ে যায় গ্যাংস্টার চন্দন মিশ্র। এই খুনের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত তৌসিফ রাজা ওরফে বাদশা। যাকে খুনের আগে হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজে সবার প্রথমে বন্দুক বের করতে দেখা গিয়েছিল। যে দৃশ্য দেখে রীতিমতো হাড় হিম হয়ে গিয়েছে সকলের। যে নিজেকে ‘কিং অফ পাটনা’ বলে। ওই দাগী দুষ্কৃতী ছাড়াও শেরু-র ডান হাত অমিত সিং ওরফে হিরোর যোগ পেয়েছে বিহার পুলিশ। ওই হিরো বিহারের গয়া জেলে বন্দি।
একসময় শেরু ও চন্দন বিহারের বক্সারের ত্রাস ছিল। দু’জনেরই বাড়ি বক্সার জেলাতেই। তবে তারা দুষ্কৃতীমূলক কার্যকলাপে ধীরে ধীরে আধিপত্য বিস্তার করে সমগ্র বিহারে। ২০০৮ থেকেই তারা বিহারের অপরাধ জগতের কিং হয়ে যায়। খুন, ডাকাতি, অপহরণ তোলাবাজিতে হাত পাকানো চন্দন ও শেরুকে রীতিমতো সমঝে চলতে বাধ্য থাকতো বিহার পুলিশ। তাদের হাত থেকে সুরক্ষিত জীবনের জন্য। বক্সারের চুন ব্যবসায়ী রাজেন্দ্র কিশোরীকে চন্দন ও সেরুর ২০১১ সালের ২১ আগস্ট রাস্তাতেই গুলি করে খুন করে। ওই ঘটনাই হুলুস্থুল বেঁধে গিয়েছিল বিহারে। তখন তারা গা ঢাকা দিয়েছিলেন নেপালে। প্রায় বছরখানেক সেখানে থাকার পর ২০১২ নাগাদ কলকাতা এলে রাজ্য পুলিশের সহযোগিতায় বিহার পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে নেয়। তাদের ঠিকানা হয় বিহারের জেল। আর সেই জেলেই উভয়ের মধ্যে ঝামেলা, বিবাদ, তর্ক। শেষমেষ বিচ্ছেদ। দু’টি নতুন গ্যাংয়ের জন্ম।
এদিকে, পুরুলিয়া শহরের সেনকো লুটের ঘটনায় শেরুর ঠিকানা হয়ে যায় পুরুলিয়া সংশোধনাগার। ওই মামলায় জামিন পেলেও বিহারের জেলে চলে গেলে সে খুন হয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কার কারণে বন্ডের তিন হাজার টাকা জমা দেয়নি শেরু। জামিন হলেও নিজের বেল না নেওয়ায় পুরুলিয়া জেলেই রয়েছে সে। গত ২২ শে জুন একটি মামলায় বিহার আদালতে হাজিরা দেওয়ার পর আবার ২৪ শে জুন সে পুরুলিয়া সংশোধনাগারে ফিরে আসে। শেরু-র স্ত্রী বিহার সরকারের কাছে লিখিত আবেদনে জানিয়েছে, তার স্বামীকে বিহারের জেলে আনলে খুন হয়ে যেতে পারে। এদিকে বিহার, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে শেরুর মামলার সংখ্যাও ভজনখানেকের বেশি। অন্যদিকে, ওই ব্যবসায়ী খুনের মামলায় বেউড় জেলেই থাকে চন্দন। তার নামে প্রায় ২৪ টি মামলা ছিল। তার মধ্যে ১২ টি খুনের মামলা। বেশ কিছুদিন ধরে তার শরীর ভালো যাচ্ছিল না। শারীরিক অসুস্থতার কারণে আদালতের নির্দেশে তাকে ১৫ দিন প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। ১৮ জুলাই ছিল শেষ দিন। গোটা বিষয়টি শেরুর কানে আসতেই ‘দুশমন’কে সরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরুলিয়া সংশোধনাগারে বসে ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করতে থাকে। হিরোর সঙ্গে যোগাযোগ করে ধৃত তৌসিফ রাজ ওরফে বাদশাকে ১০ লক্ষ টাকার সুপারি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। এই বিষয়টির খোঁজখবরে শেরুকে জিজ্ঞাসা করতে পুরুলিয়া আসছে বিহার পুলিশ। ইতিমধ্যেই পুরুলিয়া জেলা পুলিশের সঙ্গে তারা যোগাযোগও করেছে।