• আসল লড়াই ভোটার তালিকা নিয়ে, বুঝিয়ে দিলেন মমতা, ‘অনুপ্রবেশ’ প্রশ্নে পাল্টা হুঙ্কার ‘বাংলা ভাষার উপর সন্ত্রাস’!
    আনন্দবাজার | ২১ জুলাই ২০২৫
  • আগামী বছরের বিধানসভা ভোটে পদ্মফুলের সঙ্গে জোড়াফুলের আসল লড়াই যে ভোটার তালিকা নিয়ে, ২১ জুলাইয়ের সভামঞ্চ থেকে তা দল এবং সংগঠনের কাছে স্পষ্ট করে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নির্বাচন কমিশনের প্রতি ‘সম্মান’ জানিয়েও মমতা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, বিহারের মতো পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দিলে তিনি ঘেরাও কর্মসূচি করবেন। ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে লক্ষ লক্ষ মানুষের নাম বাদ দেওয়াকে সরাসরি ‘যড়যন্ত্র’ হিসাবে অভিহিত করেছেন বাংলার শাসকদলের সর্বময় নেত্রী তথা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।

    সোমবার ধর্মতলার সভা থেকে মমতা বলেন, ‘‘বিহারে ৪১ লক্ষ মানুষের নাম বাদ দিয়েছে। এর পরে ওরা বাংলাতেও করার চেষ্টা করবে। বাংলায় কারও নাম বাদ দিলে দরকারে ঘেরাও হবে। কারও নাম বাদ দিতে দেব না! বাংলা ভাষার উপর সন্ত্রাস চলছে। এই সন্ত্রাস মানব না, মানব না, মানব না!’’

    সম্প্রতি রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু আধিকারীর নেতৃত্বে রাজ্য নির্বাচন কমিশনে গিয়ে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের’ নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন বিজেপির বিধায়কেরা। বিহারের উপমা টেনে বলেছিলেন, সেখানকার মতো বাংলাতেও ‘অবৈধ’ ভোটারদের নাম তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। শুভেন্দুদের দাবি, বাংলার ভোটার তালিকায় মিশে রয়েছে ‘অনুপ্রবেশকারী’ রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাম। সেগুলি অবিলম্বে বাদ দিতে হবে। কারও নাম না-করে সোমবার ভিড়ে-ঠাসা জনসভায় মমতার পাল্টা দাবি, ‘‘এখানে কেউ কেউ বলছে বাংলায় নাকি ১৭ লক্ষ রোহিঙ্গা রয়েছেন! রাষ্ট্রপুঞ্জের সর্বেশেষ পরিসংখ্যান বলছে, সারা পৃথিবীতে রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লক্ষ। বেড়ে সেটা হয়তো ১৩ লক্ষ হয়েছে। ১৭ লক্ষ এল কোথা থেকে?’’

    মমতার ওই বক্তব্যের রেশ টেনে অনেকে বলছেন, সংখ্যা নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে। বিজেপি তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে ওই সংখ্যা যে অনেকটা বাড়িয়ে বলবে, তা অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু রোহিঙ্গারা যে এ রাজ্যে একেবারে নেই, তা-ও মমতার বক্তব্যে স্পষ্ট করে বলা নেই। বস্তুত, শুভেন্দু-সহ বিজেপি যাঁদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলছেন এবং ভোটার তালিকা থেকে তাঁদের নাম বাদ দেওয়ার দাবি তুলছেন, মমতা তাঁদের ‘বাংলাভাষী’ বলে বিজেপির বক্তব্যকে বাংলাভাষীদের উপর ‘আক্রমণ’ বলে তুলে ধরতে চেয়েছেন। বিজেপি-র বক্তব্য, বাংলার ভোটার তালিকায় যে ‘অবৈধ’ নাম রয়েছে, তার ৯০ ভাগই সংখ্যালঘু মুসলিম অংশের। এবং তাঁরা বাংলাদেশি মুসলিম অনুপ্রবেশকারী। পক্ষান্তরে, গত দেড় দশক ধরে ভোটের ফলাফল বলছে, এ রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলিমদের একচেটিয়া সমর্থন ধরে রেখেছে মমতার তৃণমূল। অর্থাৎ, বিজেপি চাইছে ‘অনুপ্রবেশকারী’ তকমা লাগিয়ে মুসলিম ভোটারদের নাম তালিকা থেকে বাদ দিতে। আর মমতা চাইছেন, তাঁদের ‘বাংলাভাষী’ বলে বাংলা ভাষার উপর ‘সন্ত্রাস’-এর বিরুদ্ধে পাল্টা আন্দোলন তৈরি করতে। যাতে তৃণমূলের মুসলিম ভোটব্যাঙ্কের উপর কোপ না পড়ে। বিজেপির বক্তব্য খণ্ডন করতে মমতা পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ভিন্‌রাজ্যে বাংলাভাষী মতুয়া এবং রাজবংশীদের উপর আক্রমণের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন।

    গত দেড় মাস ধরেই বিজেপিশাসিত বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাভাষীদের উপর ‘আক্রমণ’ নিয়ে তৃণমূল সরব। দিল্লির বাঙালি মহল্লায় বিদ্যুৎ, পানীয় জলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার প্রতিবাদে তৃণমূলের সাংসদেরা সেখানে ধর্না দিয়েছেন। ওড়িশা, মহারাষ্ট্র, ছত্তীসগড়ের মতো রাজ্যেও বাংলাভাষীদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সুর চড়াচ্ছে তৃণমূল। সোমবার ২১ জুলাইয়ের সভামঞ্চ থেকে মমতা তার সঙ্গে জুড়ে দেন ভোটার তালিকার প্রসঙ্গটিও। মঞ্চ থেকে নথি তুলে ধরে মমতা দাবি করেন, গত মে মাসে নির্দেশিকা জারি করে কেন্দ্রীয় সরকার একাধিক রাজ্যকে বলেছে, ‘বাংলাভাষী’ দেখে সন্দেহ হলে তাঁদের আটক করে ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’-এ রাখতে। জুলাই মাসে কেন্দ্র এমন আরও একটি নির্দেশিকা জারি হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।

    প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের তুলনায় ২০২৫ সালের ২১ জুলাইয়ের বক্তৃতায় মমতা অনেক বেশি ‘আক্রমণাত্মক’ ছিলেন। গত বছরের সমাবেশে মমতার বক্তৃতায় বারংবার ইডি-সিবিআই প্রসঙ্গ এসেছিল। তিনি অভিযোগ করেছিলেন, ‘এজেন্সি’ দিয়ে তৃণমূলকে ভয় দেখানো হচ্ছে। বাড়িতে ইডি-সিবিআই ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছিলেন তিনি। যাকে অনেকে খানিক ‘অভিযোগপ্রসূত রক্ষণাত্মক অবস্থান’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। এ বছর কিন্তু মমতার বক্তৃতায় ইডি-সিবিআই নিয়ে সেই সুর শোনা যায়নি। উল্টে শোনা গিয়েছে ‘বাংলা এবং বাংলাভাষী’ নিয়ে আক্রমণাত্মক, ঝাঁঝালো স্বর। যা, অনেকের মতে, বিজেপির তাঁর হাতে প্লেটে করে তুলে দেওয়া। যে ‘বাঙালি অস্মিতা’র লাইন তৃণমূল ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের সময় থেকে নিয়ে আসছে, বিজেপিই তাকে আরও ‘ধারালো’ করে দিয়েছে বলে তাঁদের অভিমত। ফলে মমতা অনেক বেশি আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়ে ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের দিক্‌নির্দেশ করতে পেরেছেন।

    ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে বাঙালি অস্মিতার লাইন নিয়েছিল তৃণমূল। যা অব্যাহত ছিল ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের প্রচারেও। ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে সেই আখ্যানের ‘গুণগত’ বদল ঘটাল বাংলার শাসকদল। বাংলা ভাষার উপর আক্রমণের প্রতিবাদে ফের একটি ভাষা আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন তৃণমূলনেত্রী। শুধু বাংলায় থাকা বাংলাভাষী নন, তাঁর ভাষণে অসমের প্রসঙ্গও এনেছেন মমতা। রাজ্যসভার সাংসদ তথা শিলচরের ‘ভূমিকন্যা’ সুস্মিতা দেবকে দায়িত্ব দিয়েছেন অসমেও আন্দোলন গড়ে তোলার। প্রয়োজনে তিনিও সেখানে যাবেন বলে জানিয়েছেন মমতা। ৫০ বছর ধরে অসমে বসবাসকারী কোচবিহারের দিনহাটার বাসিন্দা উত্তম ব্রজবাসীকে জাতীয় নাগরিকপঞ্জির নোটিস ধরিয়েছিল অসম সরকার। সোমবার মঞ্চে ছিলেন উত্তম। তাঁকে পাশে নিয়েই অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার বিরুদ্ধে তোপ দাগেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা। তিনি বলেন, ‘‘অসমের মুখ্যমন্ত্রীকে বলব, আপনি বাংলার ব্যাপারে নাক গলানো বন্ধ করুন।’’

    ভোটার তালিকা আগলাতে দলীয় সংগঠনকেও বার্তা দিয়েছেন মমতা। তাঁর কথায়, ‘‘বিধানসভা ভোটের মনোনয়ন পর্যন্ত ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দিতে পারে। আপনাদের সেটা আটকাতে হবে। কারও নাম বাদ দেওয়া যাবে না।’’ উল্লেখ্য, গত চার মাস ধরে তৃণমূল সাংগঠনিক স্তরে ভোটার তালিকা সমীক্ষার কাজ করছে। যে কাজে দলীয় সংগঠনের সঙ্গেই সমান্তরাল ভাবে ময়দানে রয়েছে রাজ্য সরকারের পরামর্শদাতা সংস্থা আইপ্যাক। তবে বিহারে ভোটার তালিকার সমীক্ষার বিষয়টির পরে তৃণমূলকেও নতুন করে সাংগঠনিক কৌশল তৈরি করতে হচ্ছে। গত দেড় মাস ধরেই তৃণমূলের অন্দরে আলোচনা চলছিল, রাজ্যের বাইরে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে নিচুতলায় সংগঠনকে নামানো হতে পারে। সোমবারের সভা থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে সেই আহ্বান জানিয়ে দিয়েছেন মমতাও। তৃণমূলনেত্রী বলেন, ‘‘আমি আমাদের পরিযায়ী শ্রমিকদের বলব, আপনারা বাংলায় ফিরে আসুন। রাজ্যে এখন কাজের অভাব নেই। আপনারা এখানেই কাজ পাবেন। বাইরে থাকতে হবে না।’’

    কেন মমতা এমন আহ্বান জানালেন, তারও ব্যাখ্যা রয়েছে। শাসকদলের অন্দরে আশঙ্কা রয়েছে, পরিযায়ী শ্রমিকেরা যেহেতু রাজ্যের বাইরে থাকেন, তাই তাঁদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওযার ‘ছক’ কষা হতে পারে। তার নেপথ্যে রয়েছে মেরুকরণের সমীকরণ। তৃণমূলের প্রথম সারির এক নেতার কথায়, ‘‘রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকদের শতকরা ৮৫ শতাংশই সংখ্যালঘু। বিজেপি সেই অংশটাকেই নিশানা করতে চাইছে।’’ তৃণমূলের অন্য একাংশের বক্তব্য, ‘‘পরিযায়ী শ্রমিকদের একটা বড় অংশ ভোটের সময়েও বাড়িতে আসেন না। রাজ্যে এমন একটা আবহ থাকলে কিন্তু তাঁরা বাড়ি ফিরবেন। যা রাজনৈতিক ভাবে আমাদের সুবিধা করে দেবে।’’

    মমতা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ভোটের লড়াইয়ে তখনই সাফল্য আসবে, যখন ভোটার তালিকা নিয়ে ‘যুদ্ধ’ জেতা যাবে। নিজের আন্দোলনের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিয়ে তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রী বলেছেন, ‘‘২১ জুলাই ১৯৯৩ থেকে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম। আমি ছাড়ার লোক নই। এক বার ধরলে আমি কিন্তু ছাড়ি না!’’
  • Link to this news (আনন্দবাজার)