• ধর্মতলার সমাবেশ মঞ্চে বক্তৃতা ‘বাছাই’ আট জনের, কে পেলেন কত নম্বর? ভাষণ বিশ্লেষণ করে নম্বর দিল আনন্দবাজার ডট কম
    আনন্দবাজার | ২১ জুলাই ২০২৫
  • বিধানসভা নির্বাচনের আগে শেষ শহিদ দিবস সমাবেশ তৃণমূলের। কাজেই তার ‘গুরুত্ব’ অন্যান্য বারের চেয়ে খানিক বেশিই। বিপুল জনসমাগমের সামনে ধর্মতলার মঞ্চ থেকে ভাষণ দিলেন মোট ১০ জন। তাঁদের মধ্যে একজন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অন্যজন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁদের ছাড়া যে বাকি আট জন ভাষণ দিলেন, তাঁদের কাউকে বাছা হয়েছিল সাংগঠনিক গুরুত্বের নিরিখে। কাউকে রাজনৈতিক ‘হাতিয়ারে’ শান দেওয়ার জন্য। কেউ নেত্রীর ‘ঘনিষ্ঠ’ রাজনৈতিক সহকর্মী হিসাবে। কেউ মতুয়া সমাজ, জনজাতি সমাজের প্রতিনিধি হিসাবে। আবার কেউ ভিন্‌রাজ্যের নেতা তথা তৃণমূলের ‘সর্বভারতীয়’ পদচিহ্নের প্রতীক।

    কার ভাষণ কেমন হল? ১০ নম্বরে কে কত পেলেন? মার্কশিট তৈরি করল আনন্দবাজার ডট কম। যে ক্রম অনুযায়ী তাঁরা বক্তৃতা করেছেন, সেই ক্রমানুযায়ীই তাঁদের প্রাপ্ত নম্বর রইল নীচের তালিকায়। তবে এই তালিকায় প্রত্যাশিত ভাবেই রাখা হয়নি তৃণমূলের দুই ‘তারকা’ বক্তা মমতা এবং অভিষেককে।

    খুব যে দারুণ বলেন, তেমন নয়। তবে বরাবরই দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত ২১ জুলাই সমাবেশের প্রথম বক্তা থাকেন। এ বারেও তা-ই ছিলেন। এই তারিখের পটভূমিকা এবং তৃণমূল প্রতিষ্ঠার ইতিহাস সম্পর্কে বলার মতো তাঁর চেয়ে প্রবীণতর আর কেউ সম্ভবত তৃণমূলে এখন নেই। দেশে নাগরিকত্বের প্রমাণ নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, সেই প্রসঙ্গে বললেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে সংগ্রাম করেছিলেন, তার ফলস্বরূপ কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত সকলে আজ সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র পেয়েছে।’’ প্রবীণ নেতার ভাষণে ‘অভিভাবকে’র স্বর। নির্দেশ দিলেন, নেত্রী নির্বাচন সংক্রান্ত বার্তা দেবেন। তা না শুনে কেউ যেন সভাস্থল না ছাড়েন।

    শান্তনু ঠাকুরকে আক্রমণ করতেই অধিকাংশ সময় নিয়ে নিলেন। তোপ দাগলেন এই বলে যে, শান্তনু টাকা নিয়ে ‘মতুয়া কার্ড’ দিচ্ছেন। অথচ সেই কার্ড দেখিয়েও মতুয়ারা হেনস্থার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না। পশ্চিমবঙ্গেও মতুয়াদের গ্রেফতার করা হচ্ছে বলে দাবি করে বসলেন। ২০০৩ সালে বাজপেয়ী সরকার ‘কালা আইন’ করেছিল বলে উল্লেখ করলেন। ঘটনাচক্রে, যে বছরে বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! বেগতিক দেখে তাঁর ভাষণ থামাতে ইন্দ্রনীল সেন কর্ডলেস মাইক টেনে নিয়ে সকলকে হাততালি দিতে বললেন।

    রাজ্যের বনমন্ত্রী তথা জনজাতি সমাজ থেকে আসা নেত্রী বিরবাহা যেমন সাবলীল ভাবে সাঁওতালিতে বললেন, দেখা গেল তিনি ততটাই স্বচ্ছন্দ বাংলাতেও। তৃণমূলের ‘শহিদ স্মরণ’ সভার বিশাল জমায়েতের সামনে দাঁড়িয়ে অনেক তাবড় নেতারও গলা কেঁপে যায়। কিন্তু বিরবাহার সপ্রতিভ ভঙ্গিতে আত্মবিশ্বাসের ছাপ স্পষ্ট। তবে গত বছরও তিনি ২১ জুলাইয়ের সমাবেশে ভাষণ দিয়েছিলেন। সে বারই প্রথম। ফলে আত্মবিশ্বাস অর্জিতই ছিল। ঝাড়খন্ড পার্টির প্রতিষ্ঠাতা নরেন হাঁসদার কন্যার ভাষণে আবার বোঝা গেল, তিনি ছোট থেকে রাজনৈতিক আবহেই বড় হয়েছেন।

    অধুনাপ্রয়াত সন্তোষমোহন দেবের কন্যা সুস্মিতাও রাজনৈতিক আবহেই বেড়ে উঠেছেন। বিরবাহার বাবার চেয়ে সুস্মিতার বাবা সন্তোষমোহনের রাজনৈতিক উচ্চতা খানিকটা বেশিই ছিল। কেন্দ্রে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দফতরের মন্ত্রী ছিলেন তিনি। শিলচরের দাপুটে নেতা হিসাবে তাঁকে অসমের মানুষ মনে রাখবেন। তাঁর কন্যা সুস্মিতার বক্তব্যে রাজনৈতিক পরিপক্কতা ছিল। তবে বাংলার বদলে অসম নিয়েই বেশি বললেন। সম্ভবত তাঁকে তেমনই বলা হয়েছিল। আইনের ছাত্রী তথা রাজ্যসভার সাংসদ সুস্মিতা দলের রাজনৈতিক লাইন থেকে কোথাও বিচ্যুত হননি। তবে তাঁর ভাষণ জমায়েতকে মাতিয়ে দিয়েছে, এমন নয়।

    শহিদ সমাবেশের বিপুল বঙ্গভাষী জনতার কাছে যে ইংরেজি ভাষা দিয়ে পৌঁছনো যায় না, মেঘালয়ের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা বর্তমান বিরোধী দলনেতা মুকুল সাংমা সম্ভবত তা জানতেন না। সে কারণেই তাঁর ভাষণও দাগ কাটতে পারল না। বাংলা দেশের জন্য কী অবদান রেখেছে এবং বাংলার সঙ্গে উত্তর-পূর্বের সম্পর্কের গভীরতার মধ্যে ঘুরপাক খেল তাঁর বক্তৃতা। ঘটনাচক্রে, তাঁর ভাষণ চলাকালীনই সভাস্থলে পৌঁছলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই জয়ধ্বনিতে তাঁর কণ্ঠস্বর ডুবে যাওয়ায় কিছুটা আচম্বিতেই সাংমাকে ভাষণ শেষ করতে হল।

    উত্তরপ্রদেশের নেতা ললিতেশপতি সে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কমলাপতি ত্রিপাঠীর পৌত্র। গত লোকসভা নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশের ভদৌহী থেকে তৃণমূলের টিকিটে লড়েছিলেন। জেতেননি। তবে ভাষণে কথা দিলেন, আগামী বার উত্তরপ্রদেশ থেকে তৃণমূলের কোনও না কোনও প্রার্থীকে লোকসভায় অবশ্যই পৌঁছে দেবেন। আরও বললেন, তাঁর আসন প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদীর বারাণসীর লাগোয়া। দাবি করলেন, পরের বার বারাণসীতে মোদীর হার নিশ্চিত করবেন! তাতেই বাংলার বিপ্লবী এবং শহিদদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো হবে।

    শহিদ সমাবেশের নিয়মিত বক্তা। তবে যতটা গর্জান, ততটা বর্ষান না। বললেন বটে, ‘‘আজ যে লড়াই হচ্ছে, তা বাঙালির অবমাননার বিরুদ্ধে লড়াই।’’ কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করতে গিয়ে ‘পুণ্য হউক, পুণ্য হউক’কে বলে বসলেন ‘পূর্ণ-পূর্ণ’। নজরুলকে উদ্ধৃত করতে গিয়েও সামান্য বিচলন ঘটল। অতুলপ্রসাদকে উদ্ধৃত করতে গিয়ে ‘নানা পরিধান’কে বললেন ‘নানা অভিধান’। বাংলা শব্দ বাছাই করতে গিয়েও খানিক অন্যমনস্কতা দেখা গেল। বঙ্গ বিজেপিকে কটাক্ষ করে ‘ছাগলের তৃতীয় সন্তান’ বাংলা প্রবচনের উপমা টানলেন। কিন্তু ইংরেজিতে বললেন, ‘ছাগলের থার্ড বাচ্চা’!

    প্রতিবারই ধর্মতলার শহিদ সমাবেশে অরূপ বিশ্বাস আসেন বাঘের আগে ‘ফেউ’ হয়ে। অর্থাৎ, তিনি ভাষণ শুরু করলেই বোঝা যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মঞ্চে আসার সময় হয়ে গিয়েছে। সোমবারও তেমনই হল। এর পরের ঘটনাপ্রবাহ— অরূপ মাঝপথে বক্তৃতা থামিয়ে মমতার নামে জয়ধ্বনি দেবেন। সোমবার অবশ্য একধাপ এগিয়ে মমতাকে ‘ভারতের মূক্তিসূর্য’ বলেছেন। এমনিতে অরূপ মমতার বক্তৃতার শ্রুতিধর। বিভিন্ন বিষয়ে মমতা সারাবছর যা বলেন, অবিকল তারই প্রতিধ্বনি অরূপের ভাষণে। বিজেপিকে আক্রমণ, কেন্দ্রের সমালোচনা রইল। আবার মমতা-সুলভ ভঙ্গিতে সকলকে এক বন্ধনীতে টেনে নেওয়াও থাকল। কালীনাম-দুর্গানাম নিয়ে বিজেপিকে যেমন কটাক্ষ করলেন, তেমনই বললেন, ‘‘রামকেও আমরা শ্রদ্ধা করি।’’
  • Link to this news (আনন্দবাজার)