প্রয়াত নকশালপন্থী নেতা আজিজুল হক, ‘লড়াকু’ নেতার মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ মুখ্যমন্ত্রীর
আনন্দবাজার | ২১ জুলাই ২০২৫
প্রয়াত হলেন নকশালপন্থী নেতা আজিজুল হক। দীর্ঘ দিন ধরেই বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন অশীতিপর এই লেখক-চিন্তাবিদ। সম্প্রতি বাড়িতে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে যায় তাঁর। তার পর থেকে ভর্তি ছিলেন সল্টলেকের একটি হাসপাতালে। সোমবার দুপুর আড়়াইটে নাগাদ হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আজিজুল। বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। তাঁর মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সমাজমাধ্যমে তিনি লিখেছেন, ‘‘আজিজুল হক একজন লড়াকু, সংগ্রামী নেতা ছিলেন। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি কখনও মাথা নত করেননি।’’ আজিজুলের পরিবারকে সমবেদনা জানিয়েছেন তিনি।
নকশালবাড়ি আন্দোলনের অন্যতম মুখ আজিজুলের জন্ম ১৯৪২ সালে, হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়া মহকুমার রণমহল গ্রামে। বিশাল জমিদারি ছিল তাঁদের। লোকে বলতো মীর সাহেবের জমিদারি। অবশ্য রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে নিজের বাবার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়ে গরিবদের মধ্যে জমি বিলিয়ে দিয়েছিলেন আজিজুল। কলকাতায় পড়াশোনা করতে এসে নন্দগোপাল ভট্টাচার্যের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাঁর। নন্দগোপালই আজিজুলকে নিয়ে যান বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছে। তার পর থেকে একের পর এক বামপন্থী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন তিনি। মাত্র ১৭ বছর বয়সে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। খাদ্য আন্দোলনের মিছিলে যোগ দিয়ে আহত হন আজিজুল। গণআন্দোলনে জ্যোতি বসুর ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলেও আগাগোড়া বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক লাইনের বিরোধিতা করে গিয়েছেন আজিজুল। নেতা হিসাবে মেনেছেন চারু মজুমদারকেই।
নকশালবাড়ি আন্দোলনের পর চারুকে নেতা মেনে সুন্দরবন এলাকায় সংগঠনের কাজে হাত দেন আজিজুল। ১৯৭০ সালে ব্যাপক পুলিশি ধরপাকড়ের মধ্যে গ্রেফতার হন। জেলের মধ্যেও প্রতিবাদ চালিয়ে যান আজিজুল। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এলে জেল থেকে মুক্তি পান তিনি। জেলের বাইরে বেরিয়েই তৈরি করেন চারু মজুমদারপন্থী সিপিআই (এমএল) দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটি। তার পর দীর্ঘ পাঁচ-ছ’বছর এই দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটি গেরিলা পদ্ধতিতে লড়াই চালায় বাংলা ও বিহারের বিস্তীর্ণ এলাকায়। ১৯৮২ সালে ফের গ্রেফতার করা হয় আজিজুলকে। জেলে তাঁর উপর অকথ্য অত্যাচার চালানো হয় বলে অভিযোগ ওঠে। জেলে আজিজুলের স্বাস্থ্যের অবনতির খবর পেয়ে দেখা করতে যান বামফ্রন্ট সরকারের তদানীন্তন দুই মন্ত্রী দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় এবং যতীন চক্রবর্তী। দু’জনেই আজিজুলকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেন। ১৯৮৯ সালে দ্বিতীয় বারের জন্য জেলমুক্ত হন আজিজুল।
দ্বিতীয় বার জেল থেকে বেরোনোর পর আর সক্রিয় রাজনীতির ময়দানে দেখা যায়নি আজিজুলকে। তার পরেও অবশ্য থেকেছেন আন্দোলনের ময়দানে। টানা লিখে গিয়েছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। জেলে বসেই লিখেছিলেন ‘কারাগারে ১৮ বছর’। পরে এই লেখা পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। জেল জীবনের অত্যাচারের কাহিনি চিত্রিত হয়েছিল এই বইয়ে। রাজনৈতিক বন্দিদের উপর অত্যাচারের এক নিষ্ঠুর দলিল হিসাবেই বইটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আজিজুলের আরও দু’টি বইও পাঠকসমাজে সমাদৃত হয়েছিল। সেগুলির একটি হল ‘লাশগুলো সব কথা বলে’। অপরটি হল ‘রক্তের টানে তিন পুরুষ’। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে বামফ্রন্ট সরকারের নীতির বিরোধিতা করলেও অন্য লেখক-সাহিত্যকদের সঙ্গে পরিবর্তনের মিছিলে পা মেলাননি আজিজুল। তাঁর ঘনিষ্ঠমহলের মানুষজন বলতেন, আজিজুল মন থেকে যা বিশ্বাস করেন, তা নিঃস্বার্থ ভাবে করেন। তবে শেষদিকে মিটিং-মিছিলেও যাওয়া কমিয়ে দিয়েছিলেন। স্নায়ুরোগের কারণে লেখালিখিতেও দাঁড়ি টানতে বাধ্য হয়েছিলেন আজিজুল।