হিন্দু রক্ষণশীল সমাজ একঘরে করেছিল দ্বিজেন্দ্রলালকে, জন্মদিনে চর্চা কৃষ্ণনগরে
বর্তমান | ২২ জুলাই ২০২৫
নিজস্ব প্রতিনিধি, কৃষ্ণনগর: কৃষ্ণনগরকে অনেকেই চেনেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের শহর হিসেবে। এই শহরের প্রতিটি কোণে রয়েছে তাঁর স্মৃতি। কিন্তু একদা কৃষ্ণনগরের রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ একঘরে করেছিল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে। তাঁর বিয়েতে বরযাত্রীদেরও যেতে বাধা দিয়েছিল তৎকালীন রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ। জীবদ্দশায় নিজের জন্মভূমিতেই ব্রাত্য হতে হয়েছিল তাঁকে। এই ঘটনা উনিশ শতকের শেষের দিকে। কারণ, তিনি কালাপানি পার করে বিলেত গিয়েছিলেন পড়াশোনা করতে।
তবে সামাজিক বয়কট দ্বিজেন্দ্রলালকে দমাতে পারেনি। গোঁড়া রক্ষণশীল সমাজপতিদের আদেশ ছিল প্রায়শ্চিত্ত করার। কিন্তু তাতে ভ্রূক্ষেপ করেননি দ্বিজেন্দ্রলাল। বরং কলমে আগুন ঝরিয়েছেন সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। ব্যাঙ্গাত্মক শব্দে প্রতিবাদ জানিয়েছেন বারবার। প্রায়শ্চিত্ত করা নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়েছিলেন, ‘হাঁ প্রায়শ্চিত্ত করিব, কিন্তু বলুন কোন্ পাপের?—আপনারা যাহা গোপনে করেন, আমরা তাহা প্রকাশ্যে করি বলিয়া? ও আপনারা যেখানে অসত্যের, অধর্ম্মের প্রশ্রয় লন, আমরা সেখানে সত্যের পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াই বলিয়া?’ তাঁর এই প্রশ্ন ভালোভাবে নেননিসমাজপতিরা।
কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে বিলেত গিয়েছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল। ১৮৮৬ সাল নাগাদ কৃষিবিজ্ঞানে সাফল্যে সঙ্গে পড়াশোনা করে দেশে ফিরেছিলেন। যদিও বিলেত সফর শুরুর আগে দ্বিধায় ছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে এনিয়ে লিখেছেন— ‘স্বাধীনতার রঙ্গভূমি ভারতবর্ষ ছাড়িয়া কোথায় এক ভীরুতার আলয়, মূৰ্খতার চণ্ডীমণ্ডপ—বিলেতে যাইতেছি,—একাজটা বড় ভালো হইতেছে না।’ আশঙ্কাই সত্যি হল। বিলেত থেকে ফিরলেও গোঁড়া সমাজপতিরা তাঁকে গ্রহণ করলেন না। কৃষ্ণনগরে ফিরে তিনি দেখলেন, পৈত্রিক বাড়ির পরিবর্তে, তাঁর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে অন্য এক বাড়িতে। এই সামাজিক বয়কট তাঁকে মানসিকভাবে কষ্ট দিয়েছিল। অভিমানী দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন এই শহর থেকে। তিনি বলেছিলেন— ‘একঘরে হওয়াতে কিছু লজ্জার বিষয় নাই। একঘরের অর্থ ‘কদাচারী’ নহে। যেখানে যে বিভিন্নমত দলের সংখ্যা অতি কম, সেখানে সে দল একঘরে। যিনি হিন্দুবিধবার বিবাহ দিয়াছিলেন, তিনি একঘরে হইয়াছিলেন। একদিন গ্যালিলিও একঘরে হইয়াছিলেন। দেখিতে পাইতেছি এ পৃথিবীতে যাঁহারা নবপ্রথার নবনীতির নবধর্ম্মের নেতা, তাহারা একঘরে।’
তৎকালীন সময়ে প্রায়শ্চিত্ত নিয়ে সমাজপতিদের আক্রমণ করে তিনি বলেছিলেন— ‘...এ মূর্খতার দালানে, এ শঠতার ভাণ্ডারঘরে, এ নীচাশয়তার আঁস্তাকুড়ে ঢুকিবার জন্য প্রায়শ্চিত্ত?—আপনাদের উন্মত্ততা অথবা ধৃষ্টতা যদি এই সমাজে ঢুকিবার জন্য বিলেতফেরতাদিগকে প্রায়শ্চিত্ত করিতে বলেন। বরং আমরা আপনাদের সমাজে এতদিন যে ছিলাম, ইহার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করিতে বলেন, রাজি আছি।...’
সেসময়ে প্রায়শ্চিত্ত না করলেও ‘হিন্দুয়ানিটা’ বজায় রাখতে বলা হয়েছিল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে। যাকে তিনি ‘ভণ্ডামি’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
কৃষ্ণনগর শহরের প্রবীণ বাসিন্দা সঞ্জিত দত্ত বলেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এই শহরের প্রাণ। কিন্তু একসময় এই শহরের রক্ষণশীল মানুষরা তাঁকে একঘরে করেছিলেন। প্রায়শ্চিত্ত করতে বললেও তিনি রাজি হননি। বরং সমাজব্যবস্থা নিয়ে সরব হয়েছিলেন।